আরেক রকম ● দশম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২২ ● ১৭-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

শৈলেন মিশ্র-র বইটি নিয়ে কয়েকটি কথা

শুভেন্দু দাশগুপ্ত


শৈলেন মিশ্রের এই বইটা ইতিহাসের বই। রাজনৈতিক ইতিহাস। ১৯৬০-৭০ দশকে বাংলায় যে নতুন বামপন্থী আন্দোলনের ধারার প্রবর্তন হয়েছিল তার ইতিহাস। এই ধারার চলতি নাম 'নকশালবাড়ির আন্দোলন'।

একটা জেলায়, বীরভূমে, সেই আন্দোলনের ইতিহাস। সেই আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক রাজনৈতিক কর্মীর, শৈলেন মিশ্রের লেখা ইতিহাস। একটা সময়ে একটা অঞ্চলের একজন রাজনৈতিক কর্মীর বয়ানে, আলোচনায়, ব্যাখ্যায় একটা রাজনৈতিক ধারার ইতিহাসের বই।

শৈলেনের বইটা বেরিয়েছে ২০২০ সালে। লেখার ঘটনা ১৯৬০-এর দশকের শেষদিক থেকে ১৯৭০-এর দশকের শেষদিক পর্যন্ত। কবে লেখা বলা নেই। ধরে নিচ্ছি শৈলেন সময় নিয়েছে লিখতে, লেখা নিয়ে ভাবতে। সেটাই দরকার। একটু সময় নিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে ভেবে লেখা। লেখার ভূগোলের পরিসর যেমন বিস্তারিত, লেখার বিষয়ের পরিসরও তেমনি বড়।

লেখার ভূগোল, রাজনৈতিক ভূগোল বীরভূম জেলার গ্রাম, শহরতলি, শহর। লেখায় থাকা মানুষজন জেলার কৃষি, শিল্প, পরিষেবার সাথে জড়িয়ে থাকা কর্মীরা, রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া চরিত্ররা।

চাষি, জমির বড় মালিক, জোতদার, দিনমজুর, বিড়ি শ্রমিক, হকার, পৌরসভার সাফাইকর্মী, যৌনকর্মী, ছাত্র, যুবক, বন্ধকী কারবারী, ধাঙর, আদিবাসী, মধ্যবিত্ত, রাইস মিলের শ্রমিক, মহাজন, বর্গাদার, খাই-খালাসি প্রথার চাষি, সুদের ব্যাপারী, মাঝারি চাষি, শিক্ষক, রুটি কারখানার শ্রমিক, পোল ও পাইপ ফ্যাক্টরির মজদুর, রিকশা চালক, দোকান কর্মচারী, গৃহবাসী, নারী, পুলিশ, ইউনিয়নের নেতা প্রমুখ। এতধরণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক স্তরের অধিবাসী, যাদেরকে নিয়ে এই আন্দোলনের বিস্তৃত ইতিহাস, সেই ইতিহাসের অগুনতি চরিত্র।

এই চরিত্রদের একটা মাপে দু'ভাগে ভাগ করা যায়, আন্দোলনের পক্ষে আর আন্দোলনের বিপক্ষে। প্রশ্ন থাকবেঃ যারা আন্দোলনের পক্ষে, তারা কেন পক্ষে? যারা আন্দোলনের পক্ষে তারা নানা মাপে আলাদা, আলাদা। অর্থনৈতিক সামর্থের মাপে, সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠিতে। ভাবনা চিন্তার বোধের পার্থক্যে। নানা ধরণের ক্ষমতার স্তরের বিন্যাসে।

এই এতধরণের মানুষ একটা আন্দোলনে সামিল হয়েছিল, বা এমনভাবেও বলা যায়, এত ধরণের মানুষকে সামিল করা হয়েছিল। তা শৈলেনের বইতে রয়েছে।

প্রশ্ন থাকেঃ তাদের সামিল করা হয়েছিল কেন? কোন তত্ত্বে? প্রশ্ন থাকবেঃ তারা সামিল হয়েছিল কেন? কোন তত্ত্ব মান্যতায়, কোন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বোধে? আমাকে সামিল করতে চাইলেই আমি হব কেন? কোথায় সেই যোগ? যোগ বানানো কোন রাজনীতিতে?

সামিল করা, সামিল হওয়ার নানা স্তর নানা পর্যায়। কাদেরকে কোন স্তর পর্যন্ত আনা গিয়েছিল? তারপর সেই স্তর আর পেরিয়ে যাওয়া যায়নি কেন? তারা থেমে গেলেন কেন?

সামিল করার, সামিল হওয়ার বিষয়টা নিয়ে আরও একটু ভিতরে যেতে তাগিদ তৈরি হচ্ছে। প্রশ্ন জাগছে? কিভাবে সামিল করা হয়েছিল? কি বলে? কোন তত্ত্বে? কি আলোচনায়?

আন্দোলন বানানো হল। আন্দোলনের কাজ কি ছিল? বীরভূমে সেই কাজগুলো করা ঠিক হয়েছিল কিভাবে? কোথায়, কখন, কিভাবে, কাদের মধ্যে, কি কাজ করা হবে? এর কি কোনো সাধারণ তত্ত্ব ও প্রয়োগ ছিল, না কি নানা অবস্থাভেদে তার স্তর ভাগ করা ছিল? এমনটা হলে এমন কি কাজ? কখনও কি আন্দোলনের কোনো একটা কাজ করার পর তার মূল্যায়ন করা হতো, আলোচনা, তর্ক হত? কি সেই তর্ক?

এবার এই প্রশ্ন করার তালিকা থামানো যাক। এভাবে একটা বই নিয়ে অনন্তর প্রশ্ন করা ঠিক নয়।

এমনটা হচ্ছে কারণ, নিজে একদিন, কোনো না কোনো ভাবে এই আন্দোলনে ছিলাম, থাকতে থাকতে, চলে এসে, ফিরে তাকানোয় এই প্রশ্নগুলো তৈরি হয়েছিল, ছিল, থেকে গিয়েছিল, থেকে আছে, এখনও। এতকাল পরে এই বার্ধক্যেও। তবে মনে করি এটা শুধুই আমার, আমাদেরই প্রশ্ন, জানার ইচ্ছে, বোঝার তাগিদ নয়। যারা ভিতরে ছিল না, বাইরে ছিল, কিন্তু বিপরীতে ছিল না, যারা তখন ছিল না এখন জানতে চায়, তাদেরও।

আর উত্তর দেবার দায় শৈলেনের, শৈলেনের সহযোদ্ধাদের, পথসাথীদেরও। নয়তো এরপর যারা এমনতর আন্দোলন বানাবে। এমনতর আন্দোলনে আসবে, থাকবে তাদের জন্য রসদ রেখে যাওয়া, রেখে দেওয়া হবে কিভাবে? তারা কি করবে, কিভাবে করবে, আর কি করবে না, কেন করবে না, ইতিহাস থেকে জানা, শিক্ষা নেওয়া। এমন নয় যে এসব বিষয় শৈলেনের এই বইটিতে নেই। আছে। তবে শৈলেনের যেমন যেমন মনে হয়েছে। লিখতে চেয়েছে, বলতে ইচ্ছে হয়েছে সেভাবে। আত্মকথার ঢঙে। আমি আরও কিছু বেশি চাইছি। আত্মকথাকে ইতিহাস লেখার ঢঙে। আত্মকথা যখন আত্মকে ছাড়িয়ে ইতিহাসকে কথক করে তুলবে। পাঠককে পরিশ্রম করার বদলে লেখক শৈলেন সে 'পরিশ্রম'টি করবে।

এমন কথাটি লেখার অন্য কারণ আছে। নকশালবাড়ির আন্দোলন নিয়ে, যারা আন্দোলনে ছিল তারা লিখেছে। প্রবন্ধ, বই, সাক্ষাৎকার। সেসব যতটা পড়েছি সেখানেও যে যে প্রশ্ন শৈলেনের বইটা নিয়ে মাথায় এল, সেসব প্রশ্ন তখনও এসেছিল।

শৈলেনের লেখা পড়ে তাদের লেখার কথাও মনে আসছে। ভাবনাতেও। লেখকদের মধ্যে যারা পরিচিত, তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলাম কথায়, লিখে নয়।

এখন সুযোগ পেয়ে শৈলেনের লেখা নিয়ে প্রশ্ন রাখছি লিখেই। এ প্রশ্ন শুধু শৈলেনের বইকে নিয়ে নয়। নকশালবাড়ি আন্দোলনের কর্মীদের লেখা নিয়েও। অন্য অন্য কর্মী যাদের লেখা পড়েছি।

এখানে, এই লেখাতে প্রশ্ন সাজাচ্ছি শৈলেনের বইকে নিয়েই। প্রশ্ন রেখেছি আগে, এই লেখাটিতেই, প্রশ্ন রাখছি এখন।

খুব যে একটা গুছিয়ে প্রশ্ন রেখেছি তা নয়, গুছিয়ে প্রশ্ন রাখতে পারব, তাও নয়। বইটা পড়ে যেমন যেমন মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তেমন তোমন রাখছি। ঠিকঠাক পর সময়ের হিসাব মিলিয়ে নয়।

রাজনীতি করতে আসা। রাজনীতি করতে আনা। শৈলেন, বীরেন ঘোষের প্রভাবে রাজনৈতিক কর্মী হয়ে যায়। শুধু একজনের কথার প্রভাবেই কি রাজনৈতিক কর্মী হওয়া যায়? হওয়া কি ঠিক? নিজস্ব কোনো প্রশ্ন বানানো, উত্তর খোঁজা, সন্ধান পাঠ, বোধ ছাড়া।

শৈলেন 'রেড গার্ড' সংগঠনের সদস্য হিসেবে গ্রামে গিয়েছিল। প্রশ্নঃ গ্রামে গিয়ে কৃষকদের কি কি সমস্যা জানা গেল? সেই সমস্যাগুলিকে কিভাবে এবং কোন তত্ত্বে ও প্রয়োগে নিয়ে আসা হল?

শৈলেন প্রথমে ক্লাবের সদস্যদের, পরে বিভিন্ন পাড়ার ছাত্র, যুবক ও সমাজের অন্যান্য অংশকে নকশালবাড়ির রাজনীতিতে আনার চেষ্টা করেছিল। প্রশ্নঃ শৈলেন কি বলে, কি আলোচনা করে, কি যুক্তিতে তাদের রাজনীতিতে আনার চেষ্টা করেছিল? যাদেরকে আনার চেষ্টা করেছিল তারা কি কি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করত? সেই প্রশ্নের কি উত্তর দেওয়া হত?

শৈলেন জানিয়েছে রাইস মিলের শ্রমিকদের, বিড়ির কারিগরদের মধ্যে পার্টির সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করা হয়েছিল। পার্টির সংগঠন গড়ে তোলার জন্য ওদেরকে কি বলা হত? ওরা কি বলত? কতজন পার্টিতে এসেছিল?

নকশালবাড়ির আন্দোলনের তত্ত্বে শ্রমিকদের শ্রমিক আন্দোলন জায়গা পায়নি। শ্রমিকরা নিজেদের আন্দোলন ছেড়ে কৃষক আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি?

এমনতর প্রশ্ন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি, তাই আর নয়। শেষ করি প্রশ্নের উত্তরের একটা উদাহরণ দিয়ে। তাতে বোঝা যাবে কেন আমি এই ধরনের প্রশ্ন করে চলেছি শৈলেনের বইটা পড়ে।

একটি দিনে একটি বিশেষ অবস্থায় মুলুক গ্রামের একজন ভূমিহীন কৃষক জিজ্ঞাসা করেছিল শৈলেনকে পাশাপাশি পথ হাঁটতে হাঁটতে, "নকশালরা কি চায়?"। শৈলেন বলেছিল, "আমরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাই। বৃহৎ পুঁজিপতি, বড় জমিদার এবং সাম্রাজ্যবাদীদের উৎখাত করে শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত মানুষের রাজ কায়েম করতে চাই। গ্রামাঞ্চলে জোতদারদের কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করে গরিব ভূমিহীন কৃষকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তাই গ্রামে গ্রামে বিপ্লবী কমিটি গড়তে হবে।"

শৈলেনের এই কথায় কৃষক মানুষটি কিছু বুঝেছিলেন? সত্যিই কি বোঝা সম্ভব?

কোনো একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব বানানো যত কঠিন, সেই তত্ত্বকে প্রয়োগে নিয়ে যাওয়া একইরকম, বোধহয় আরও বেশি কঠিন।

শৈলেনের বইতে বারবার এসেছে খুবই জরুরি একটা বিষয়। সমস্ত আন্দোলনের 'কষ্টভূমি'র নেপথ্যে থাকে 'মদতভূমি'। সেই ভূমির বাসিন্দারা সরাসরি আন্দোলনে যোগ দেয় না, আন্দোলনে সাহায্য করে। এমন কাজের, এমন কাজে থাকা মানুষজনের অনেক উদাহরণ আছে। শৈলেনের বইতেই। প্রশ্ন থাকে কিভাবে গড়ে তোলা এই 'মদতভূমি'? যারা মদত দিতেন, কেন দিতেন?

শৈলেন একটা সময়ে অন্য সংগঠনে যুক্ত হয়। সিপিআই(এমএল) ইউনিট কমিটি, সিপিআই(এমএল) প্রভিশনাল সেন্ট্রাল কমিটি।

বীরভূমের কয়েকটি গ্রামে সেই আন্দোলনের বিষয় ছিল জমি দখল, মহাজনী কারবার বিরোধিতা, বর্গা আন্দোলন, মজুরি, ইজ্জতের প্রশ্ন, খাই-খালাসি প্রথা রদ, সামাজিক ন্যায়, খুবই জরুরি অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়, যার সাথে বিভিন্ন অংশের রাজনৈতিক ক্ষমতা জড়িয়ে আছে।

বিভিন্ন গ্রামে 'জনগণের কমিটি', 'গ্রামরক্ষা বাহিনী' তৈরি করা, অত্যাচারী বদবাবুদের, থানার দারোগাদের বিরুদ্ধে বিচারসভা বসানো, জরিমানা দিতে বাধ্য করা, জোতদারদের সুদ-বন্ধকী ফেরত দিতে বাধ্য করা, জমি ও পুকুর দখল করা, কৃষকদের যৌথ খামার ও চাষবাস করতে উৎসাহিত করা, গ্রামে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করা।

শৈলেনের যোগ দেওয়া প্রথম আন্দোলনটি সফল হয়নি, দ্বিতীয়টি সফল। এর কারণ কি? শৈলেনের লেখায় থাকলে একটা খুব দরকারি কাজ হতো। শৈলেন যদি কারণগুলি গুছিয়ে বলত, তাহলে এখন সেই আন্দোলনগুলি আবার শুরু করা যায় কিনা, করলে কি করতে হবে, কি করতে হবে না, এর একটা আন্দাজ পাওয়া যেত।

এই কথাগুলি বলছি কেন? একদিন যে যে অন্যায়ের প্রতিবাদ, প্রতিরোধে রাজনৈতিক আন্দোলন শৈলেনরা শুরু করেছিল, তা তো এখনও রয়েছে, চেহারা চরিত্র বদলেছে, বদলালেও, এখন যারা আন্দোলনে যেতে চায়, যাবেই, তারা জেনে নিতে পারত তাদের কাজের ধরণটা কেমন হবে।

পরের প্রজন্ম আগের প্রজন্মের কাছে জানতে চাইবে, চাইবেই, আর সেটা আগের প্রজন্মের দায়। আর রাজনৈতিক ইতিহাসের সেটাই তো একটা কাজ। রাজনৈতিক ইতিহাস রচয়িতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তো তাই হওয়া। বিশেষতঃ ইতিহাসকার যদি নিজেই সেই ইতিহাসের অংশগ্রহণকারী হয়ে থাকে। সেহেতু শৈলেনের কাছে আমাদের দাবি অন্য রাজনৈতিক ইতিহাসে থেকে আলাদা। যে ঐতিহাসিকরা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ছিলেন না।

আলোচকের দাবির সাথে লেখকের উদ্দেশ্য না মিললেই তা ঠিক নয়, এমন কথা আমার নয়। যা আছে, যতটা আছে ততটাই মূল্যবান, দরকারি, ভবিষ্যতের কাজে লাগার মতো। এটাই বা কোথায় পাচ্ছি। এমন কথা বলতে আমি পিছপা নই।

শৈলেন বন্ধু মানুষ, আমার আন্দোলন রাজনীতির সহযাত্রী, তাই এতগুলো কথা লিখে ফেললাম তাগিদে, বোধে, দাবিতে, বন্ধুতায়, রাজনীতিকতায়।


নকশাল আন্দোলনঃ মানুষের ভূমিকা
শৈলেন মিশ্র
প্রকাশকঃ গাংচিল, কলকাতা
ISBN: 9789 38644 3090