আরেক রকম ● দশম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২২ ● ১৭-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

গণতন্ত্রের পূজারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এখন বিশ্বশান্তির প্রশ্নে বড় চ্যালেঞ্জ

নিখিলরঞ্জন গুহ


বিশ্বের সামনে নতুন বিপদ হিসেবে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণ এখন ভূ-রাজনীতিতে প্রধান আলোচ্য বিষয়। কিন্তু এটা থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যে এই যুদ্ধ থেমে গেলেই বিশ্বে স্বস্তি ফিরে আসবে। আন্তর্জাতিক বাজার দখলের প্রশ্নে যুদ্ধ একটা উপাদান হিসেবে কাজ করে। ভোগ্যপণ্যের সাথে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির বাজার দখল নিয়ে প্রতিযোগিতায় অস্থির বিশ্বের ভূমিকাকে তাই অস্বীকার করা যায় না। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে এই প্রতিযোগিতায় ভাটা পড়তে বাধ্য।

এই প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে আলোচনা করা যায় না। বিশ্ব বাণিজ্যে প্রাধান্য বিস্তারে অশান্ত বিশ্ব এই দেশটির সমৃদ্ধির একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে তাই তার উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই প্রশ্নে তার নীতির বিরুদ্ধে যাওয়া কোনও সরকারের পতন ঘটানো বা 'পুতুল সরকার' গঠনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। ইরাকে সাদ্দাম হুসেইনের করুণ পরিণতি এবং লিবিয়া তার বড় দৃষ্টান্ত। কিউবার ক্ষেত্রে বার বার ব্যর্থ চেষ্টার মধ্যেও তা প্রতিভাত হতে দেখা যায়। এইক্ষেত্রে দেশটির মধ্যে রাজনৈতিক সততা বা নৈতিক দায়বদ্ধতা লক্ষ্য করা যায় না। লক্ষ্যণীয় হল তাইওয়ানের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি নিয়ে চলেছে ইউক্রেনের ডোনেৎস এবং লুহানসকের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান ঠিক তার বিপরীত। তাইওয়ানের মানুষ স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে পৃথক থাকতে আগ্রহী। সেখানেও এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটা বিরোধ চলছে। এটা অবশ্যই সেই দেশের একটা অভ্যন্তরীণ সমস্যা। বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমী দেশগুলি তাইওয়ানকে শুধু যে প্ররোচনা দিয়েই খান্ত থেকেছে তাই নয় ঋণ এবং অস্ত্র দিয়েও সাহায্য করে চলেছে। অবশ্যই তা বাণিজ্যের অংশ হিসেবে। উদ্দেশ্য চিনকে ব্যতিব্যস্ত রাখা। শুধু তাই নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন সরকারের আপত্তি সত্বেও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি পাঠানোর মধ্য দিয়ে, প্রত্যক্ষভাবে তাইওয়ানের চিন বিরোধী লড়াইকে ইন্ধন দিতে অধুনা বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাইওয়ানের সাথে চিনের বিরোধ ভিন্ন মাত্রা পেতে চলেছে । চিন নিজের দাবি প্রতিষ্ঠায় সেখানে সামরিক অভিযান চালালে আরও একটা ইউক্রেন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। অথচ দেখা যাচ্ছে ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে ডোনবাসের ডোনেৎতস এবং লুহানসকের মানুষ একই দাবি নিয়ে লড়ছে ১৯৯৪ সাল থেকে। ১৯৯১ সালে গণভোটে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বিছিন্ন হয়ে ইউক্রেনের সাথে যুক্ত হলেও অল্প দিনের মধ্যেই তাদের মোহমুক্তি ঘটে। ইউক্রেনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হলে এই অঞ্চলের মানুষের ওপর নেমে আসে কিয়েভের সামরিক অভিযান। এই ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন নিয়ন্ত্রিত ন্যাটো, ইউক্রেন সরকারকে সাহায্যে করতে এগিয়ে আসে। এই সাহায্যের পক্ষে যুক্তি হিসেবে এই বিদ্রোহীদের বিছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যমগুলির কৌশলী প্রচার সেইভাবেই বিশ্ববাসীকে ভাবাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এমন কী সেই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাটো ভুক্ত হওয়ার প্রস্তাবে অসম্মত হলে তদানীন্তন প্রেসিডেন্টকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় এবং সেখানেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের এই লড়াই যদি বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন হয়ে থাকে তবে তাইওয়ানের ক্ষেত্রে তা নয় কেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার উত্তর নেই। ডোনেৎস এবং লুহানসকে সামরিক অভিযানে মুক্তিসংগ্রামী ১৪,০০০ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। অনিবার্যভাবেই ইউক্রেনের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এই অংশের অস্থায়ী সরকার স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে সাহায্য চেয়ে তাদের মূল ভূখণ্ড রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশগুলিতে যেমন মার্কিন অস্ত্রের চাহিদা বেড়েছে তেমনই ইউক্রেনকেও সামরিক অস্ত্রের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।

ভারতে কাশ্মীর প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীতিগতভাবে গণভোটের পক্ষে হলেও ডোনেৎস এবং লুহানসকের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। বরং ইউক্রেনের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর শক্তি বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে। এই কারণেই ১৯৯৪ এবং ১৯১৪ সালে ডোনেৎস এবং লুহানসকের মানুষ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে গণভোটে ব্যাপকভাবে সারা দিলেও ইউক্রেন সরকার তা অস্বীকার করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনের পক্ষ নিতে দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একই ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময়। সেখানে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নীতিকে অস্বীকার করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সরকারের পাশে এসে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম তথা ভারতের পক্ষ নিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন দ্বিচারিতা নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি পাকিস্তানের পালা বদলের প্রশ্নেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা লক্ষ্য করার মতো। এবং ভারতের ওপরও একই ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমী প্ররোচনায় রাশিয়া থেকে বেরিয়ে যাওয়া স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদাপ্রাপ্ত দেশগুলি রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রয়োজনে ন্যাটোর ভুক্ত হবে না এমন একটা বোঝাপড়া থাকলেও পরবর্তীতে তা লঙ্ঘিত হতে দেখা গিয়েছে। ১৯৪৯ সালে যে সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ তা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩০। এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার পথে। লক্ষ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার যুদ্ধজোট ন্যাটোর কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ রাশিয়ার অস্তিত্বকে বিপন্ন করা। ন্যাটোর এই বিস্তৃতি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের শর্তকেই শুধু ভেঙেছে তাই নয় সেই সাথে ইউরোপে যুদ্ধ উত্তেজনাকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে। কারণ রাশিয়া তার অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে কোনওভাবেই তার নাকের ডগায় এই রাষ্ট্রগুলিতে মার্কিন ঘাঁটি তৈরি করার সুযোগ দিতে চাইবে না। সে ক্ষেত্রে যেকোনো ঝুঁকি নিতেও তারা প্রস্তুত থাকবে। ইউক্রেনই তার উদাহরণ। প্রকৃত প্রস্তাবে ভোগ্যপণ্য এবং যুদ্ধাস্ত্রের বাজার দখলের লড়াইয়ে মরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন নীতিই বর্তমান বিশ্বের প্রধান বিপদ।

ইউরোপের দেশগুলিও যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত নয় তা নয়। বলা যায় রাশিয়া বাদে সমগ্র ইউরোপ পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া অর্থনৈতিক উপনিবেশেই শুধু পরিণত হয়েছে তাই নয় অবশিষ্ট বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে চলেছে। তাই কোনও কোনও ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটলেও তাদের পক্ষে স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করা যেমন সম্ভব হয়ে উঠছে না তেমনই স্বাধীন বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করাও তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছে।