আরেক রকম ● দশম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২২ ● ১৭-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ম্যান ইন ইন্ডিয়াঃ শতবর্ষে বিস্মৃত নৃতত্বের ভারতীয় পত্রিকা

নবকুমার দুয়ারী


পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসকের প্রশাসনিক সুবিধার্থে ও তাদের বদান্যতায় নৃতত্ত্বচর্চার শুরু হয়। আর এই চর্চার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতায় ১৭৮৪ সালে স্যার উইলিয়াম জোন্স দ্বারা স্থাপিত 'এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল' শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।


'ম্যান ইন ইন্ডিয়া'-র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সম্পাদক রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায় (জন্মঃ ৪ নভেম্বর, ১৮৭১ - মৃত্যুঃ ৩০ এপ্রিল, ১৯৪২)
 

আইনজীবী রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায় ১৮৯৪ সালে কলকাতা থেকে রাঁচি যান ও ছোটনাগরপুর জুডিশিয়াল কোর্টে প্রাকটিস শুরু করেন। এই সময় তিনি সরল সাধাসিধে স্থানীয় আদিবাসীদের মক্কেল হিসাবে পান। আর তাদের আইনী সমস্যার দূর করার কারণে তিনি জেনেছিলেন আদিবাসী সমাজের ভাষা, প্রথাগত রীতিনীতি, আইনী ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির নানান দিক, যাতে তাদের হয়ে জমিদার ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই করা যায়। তিনি রাঁচিতে স্থায়ীভাবে থেকে যান। ১৯১২ সালে তাঁর প্রকাশিত ‘মুন্ডা এন্ড দেয়ার কান্ট্রি’ এদেশের প্রথম এথনোগ্রাফি অ্যাকাউন্ট, যা ছিল ছোটনাগপুরে আদিবাসীদের উপর মৌলিক গবেষণা। এই বইয়ের দীর্ঘ সূচনা অধ্যায়টি লেখেন অবিভক্ত উড়িষ্যার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ই. এ. গেইট, যিনি পরবর্তিকালে প্রাশাসক হিসাবে এদেশের বিভিন্ন জনজাতির উপর বেশ কয়েকটি মূল্যবান ঔপনিবেশ অধ্যয়নকে প্রকাশ করেন। প্রখ্যাত বিদেশি নৃতত্ত্ববিদ জেমস ফ্রেজার এবং এ. সি হ্যাডন নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা এই বইটির ভূয়সী প্রশংসা করে শরৎচন্দ্র রায় মহাশয়কে চিঠি লিখে জানান। এতে তিনি খুবই উৎসাহিত হন। আরও গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন আদিবাসী ও নৃতত্ত্ব চর্চায়। সেই সময় ভারতে বিখ্যাত তিনটি জার্নাল প্রকাশিত হত - 'এশিয়াটিক সোসাইটি', 'ক্যালকাটা রিভিউ' ও বোম্বে থেকে 'ইন্ডিয়ান অ্যানটিকুইটি'। ভারতীয়দের লেখা কোনও প্রবন্ধ প্রকাশ করাটা খুব দূরূহ ছিল। তাই তিনি নৃতত্ত্বের একটা নতুন জার্নাল প্রকাশের প্রয়োজন অনুভব করতে থাকেন।

১৯১৮-য় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্যতম বিষয় হিসাবে প্রথম নৃতত্ত্ব পঠনপাঠন শুরু হয়। এর দু'বছর পরে ভারতে প্রথম নৃতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয় জুলাই ১৯২০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে। তিন জন ছাত্র নিয়ে শুরু - শিশির কুমার হোড়, তারক চন্দ্র রায়চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ বসু। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে শরৎচন্দ্র রায় এই বিভাগে সাময়িকভাবে পঠনপাঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯২১ সালে শরৎচন্দ্র রায় মহাশয় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেষ্টায় ও নিজের সম্পাদনায় ভারতে নৃতত্ত্বচর্চার প্রথম ত্রৈমাসিক ইংরেজি জার্নাল ‘ম্যান ইন ইন্ডিয়া’ প্রকাশ করেন তদানীন্তন বিহারের ছোটনাগপুর মালভূমির ছোট্ট শহর রাঁচির জি. ই. এল. প্রেস থেকে। মাত্র চারটি প্রবন্ধ নিয়ে ৮৪ পৃষ্ঠার জার্নালটির আত্মপ্রকাশ হয়। প্রথম সংখ্যায় লিখলেন ডব্লিউ. ক্রুক, ডব্লিউ. এইচ. আর. রিভার্স, রায় বাহাদুর হীরালাল ও সম্পাদক নিজেই। বার্ষিক মূল্য নির্ধারণ হয় ৮ টাকা। ঠিকানা 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া' অফিস, চার্চ রোড, রাঁচি, বিহার। 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া'র পরপর দুটি সংখ্যা ভারতসহ বিদেশে বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায়। জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের বিষয় ও মান দেখে পশ্চিমী দেশের খ্যাতনামা নৃতত্ত্ববিদ ও স্কলাররা সম্পাদক মহাশয়কে চিঠি লিখে ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন স্যার জে. জি. ফ্রেজার, আর. বি. ডিকশন, স্যার আর্থার কিথ প্রমুখ।

১৯২১ সালে প্রথম খণ্ডের তিনটি সংখ্যায় চোখ রাখলে দেখা যায় বিদেশী গবেষকদের লেখায় প্রকাশিত হয় ভারতীয় সমাজের বিশেষ বিশেষ বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ দিক। যেমন ডব্লিউ ক্রুক উপদেশমূলক এক প্রবন্ধে লিখলেন ভারতে নৃতত্ত্ব অনুসন্ধানে পরিকল্পনার কথা; ডব্লিউ. এইচ. আর. রিভার্স লিখলেন আত্মীয়তা ও বিবাহ, টি. সি. হাডসন লিখলেন ভারতের সংস্কৃতিকে ঘিরে চারটি দীর্ঘ প্রবন্ধ - পুনর্জন্মের নানান মতবাদ, প্রাচীন কাল থেকে ভাগ্নেকে কিভাবে উত্তরাধিকার বর্তায়, অসবর্ণ বিবাহ, গারো ও খাসি আদিবাসীদের বিয়ের রীতিনীতির বিপরীত ধর্মী আচার ও বৃক্ষ বিবাহ; ডি. এইচ. মোর্ট্রি ও এস. সি. রায় (শরৎচন্দ্র রায়) যৌথভাবে প্রবন্ধে লিখলেন ভারতের লোকসংস্কৃতি ও লোক সমাজ। এছাড়াও এস. সি. রায় এককভাবে লিখলেন ভারতে নৃতত্ত্ব গবেষণা, লোক সংস্কৃতিতে জাত-পাত, খাসিদের সামাজিক সম্বন্ধের কিছু শব্দগুচ্ছ, ওরাওঁদের ধর্ম আন্দোলন এবং সংস্কৃতির নানারকমের তাত্ত্বিক দিক। পি. ও. বোর্ডিং লিখলেন ভারতের প্রস্তর যুগ ও সাঁওতালদের মধ্যে খেরওয়াল আন্দোলন; কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক কে. পি. চট্টোপাধ্যায় লিখলেন মালায়লাম ভাষার নানান শব্দ ও প্রয়োগের বর্ণনা, হীরালাল লিখলেন ভারতের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে নরবলির কথা। এইভাবেই ‘ম্যান ইন ইন্ডিয়া’ পত্রিকাটিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে।

এদিকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ধীরে ধীরে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর বিভাগে নৃতত্ত্ব পঠনপাঠন শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে ডক্টর বি. এস. গুহ-র চেষ্টায় বেনারসে স্থাপিত হয় বিশ্বে সর্ববৃহৎ নৃতত্ত্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যানথ্রপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’। দেশবিদেশের নৃতত্ত্ববিদ তাঁদের গবেষণার ফলাফল ‘ম্যান ইন ইন্ডিয়া’ জার্নালে প্রকাশিত করতে থাকেন। প্রকাশিত হতে থাকে নৃতত্ত্ব বিষয়ক অনেক খবরাখবর, বিজ্ঞপ্তি ও বিজ্ঞাপন, যেমন পুস্তক প্রকাশ, পুস্তক সমালোচনা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, শোকবার্তা ইত্যাদি। দেশ বিদেশের সদ্যপ্রয়াত খ্যাতনামা নৃতত্ত্ববিদদের সংক্ষিপ্ত জীবনীও সেখানে প্রকাশিত হতে থাকে।

আজ পর্যন্ত ২২টি বিচিত্র বিষয়ে জার্নালের বিশেষ বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছে। এই সংখ্যাগুলি দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সম্পাদনা করেছেন। প্রকাশিত হয়েছে তিন হাজারেরও অধিক প্রবন্ধ। প্রকাশিত হয়েছে নৃতত্ত্বের সমস্ত শাখার অর্থাৎ সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, শারীরিক নৃবিজ্ঞান ও প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধসহ লোকসংস্কৃতি, সমাজ বিজ্ঞান, সোশ্যাল ওয়ার্ক, ভাষাবিজ্ঞান, হিউম্যান জিওগ্রাফি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, হিউম্যান জেনেটিক্স, মলিকিউলার ডিএনএ স্টাডি, চিকিৎসা বিজ্ঞান, শিল্প, স্থাপত্য, কৃষিবিজ্ঞান, আদিবাসী চর্চার তাত্ত্বিক দিকসহ ক্ষেত্র সমীক্ষায় উঠে আসা ফলাফল ও সমসাময়িক বিশেষ বিশেষ বিষয়। এই চর্চায় বিষয় জাতি পরিচয়, ভাষা, শিক্ষা স্থানান্তর, জীবিকা, অর্থনৈতিক, চাষবাস, মিথ, লোককথা, লোকগান, শিল্প, স্থাপত্য, আদিবাসী, পূজা-পাঠ, ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথাগত জ্ঞান, সামাজিক পরিবর্তন, মানুষের শারীরিক গঠন বৈচিত্র, রোগ, স্বাস্থ্য, পুষ্টি বিষয়ক, মানুষের বিবর্তন, প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি চর্চার নানাদিক, সরকারি পরিকাঠামো, পরিকল্পনার পর্যালোচনা ও নানান সমস্যার কথা।

রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায় আমৃত্যু 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া' সম্পাদনা করেন। তাঁর অবর্তমানে জার্নালটি সম্পাদনা করেন তাঁর পুত্রদ্বয় রমেশচন্দ্র রায় (মে, ১৯৪৩ - ডিসেম্বর, ১৯৫৪) ও ভবেশচন্দ্র রায় (জানুয়ারি, ১৯৫৫ - আগস্ট, ১৯৫৮)। সহযোগী সম্পাদক ছিলেন ডব্লিউ. জি. আর্চার, ভেরিয়ার এল্যুইন, লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও মহাত্মা গান্ধীর পার্সোনাল সেক্রেটারি ও 'এনথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'-র নির্দেশক অধ্যাপক নির্মল কুমার বসু। অধ্যাপক বসুর মৃত্যুর পর (১৯৭২) তাঁর সুযোগ্য ছাত্র অধ্যাপক সুরজিৎ চন্দ্র সিনহা (১৯৭৩-১৯৮৭) সেই দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় তিনি 'অ্যানথ্রপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'র নির্দেশক, 'বিশ্বভারতী'র উপাচার্য এবং 'সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস'-এর নির্দেশক ছিলেন। এরপর 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া'র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর রেবতী মোহন সরকার। ২০১৮ সালে তাঁর প্রয়াণের পর 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া' দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডক্টর সুমহান বন্দোপাধ্যায়। জার্নালের নানান পরিবর্তন ঘটেছে সময়ের সাথে সাথে। যেমন পরিবর্তন ঘটেছে তার অবয়বের, তেমনি নৃতত্ত্ব চর্চায়, গবেষণার ধারায়, প্রয়োগ ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রেরও। সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে গ্রাহক মূল্য। 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া' জার্নালটি ভারতসহ পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশে নৃতত্ত্বসহ সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সমাদৃত হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে দিল্লির এক পাবলিশিং হাউজ থেকে 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া' প্রকাশিত হচ্ছে। এর পূর্বে সম্পাদকদের পছন্দ ও কাজের সুবিধার কারণে এটি প্রকাশিত হত রাঁচি, কলকাতা ও লখনউ থেকে।

দেখতে দেখতে এ দেশের প্রথাগত ধারায় নৃতত্ত্ব চর্চার একশ বছর ও নৃতত্ত্ব চর্চার জার্নালটিরও শত বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০১৯-২০২০ সময়টা ভারতের নৃতত্ত্ব চর্চার এক যুগসন্ধিক্ষণ। এত সবের মধ্যেও কোথাও যেন এক বেসুরো সুর বাজে। ভারতের নৃতত্ত্ব চর্চার পীঠস্থান 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া' অফিসের চিহ্নটুকুও আজ আর নেই। সেই স্থানে তৈরি হয়েছে গগনচুম্বি বহুতল আবাসন। নেই 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া' অফিসের গ্রন্থাগার, নেই বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের ব্যবহৃত দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্রের সংগ্রহ, আসবাবপত্র ও প্রতিষ্ঠাতার ছবি আরো কত কিছু। এ আমাদের লজ্জা, বড় বেদনাদায়ক এই পরিণতি। ভারতে নৃতত্ত্ব চর্চার জনক রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায়ের সৃষ্টি 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া'-র মতো এক যুগান্তকারী নৃতত্ত্ব চর্চার খ্যাতনামা জার্নালটি শতবর্ষ কাটলো নিভৃতে।