আরেক রকম ● দশম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২২ ● ১৭-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

মোদীর বিদেশ নীতি

অর্ধেন্দু সেন


ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের অনেকেই বিদেশ নীতিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। পণ্ডিত নেহেরু তো বটেই ইন্দর গুজরাল, নরসিমহা রাও, অটলবিহারী বাজপেয়ী বিদেশ নীতিতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। শুধু তাই নয় এ বিষয়ে তাঁদের পড়ালেখাও ছিল বিস্তর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীও যে প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই ঐচ্ছিক বিষয়ে এতোটা সময় দেবেন তা কেউই ভাবেনি। মোদী সাধারণ পরিবারের ছেলে। এ কথা তিনি আমাদের প্রায়ই মনে করিয়ে দেন। কোনও ডাইনাস্টির সুপুত্র তিনি নন। অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজ হার্ভার্ডের ধারে কাছে যাননি। কাঁটা চামচের ব্যাপারটা তাঁর রক্তে নেই। তাছাড়া তিনি ঘোর হিন্দুত্ববাদী। তাঁকে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে এক টেবিলে দেখলে তাঁর ভক্তবৃন্দের বিমর্ষ হবার কথা। অথচ দেখা গেল তিনি এই কাজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন কোমর বেঁধে। সংসদে তখন তাঁকে খুব একটা দেখা যায়না। শোনা গেল আসন গ্রহণ করে তিনি সিটবেল্ট খোঁজেন।

কি কারণে তিনি বিদেশ নীতির দিকে ঝুঁকলেন এইভাবে? নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গোধরা কাণ্ড ঘটল। তারপর তিনি একাধিকবার চেষ্টা করেছেন আমেরিকায় যেতে। মানবাধিকার কর্মীদের আপত্তিতে আমেরিকার সরকার তাঁর ভিসার আবেদন মঞ্জুর করেনি। কূটনীতিক মহলে তাঁর যে নিজস্ব কোনও পরিচিতি বা যোগাযোগ ছিল তা নয়। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ চিরকাল মনে করেছে হিন্দুর দেশ ভারত বিশ্বে শ্রেষ্ঠ। নতুন করে তাকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করা অনর্থক।

বলা যায় মোদীর একমাত্র মূলধন ছিল মনমোহন সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য। ইউপিএ আমলে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৮-১০ পারসেন্ট। আমদানি-রপ্তানিও আগের তুলনায় অনেক গুণ। মোদী এইটুকু বুঝেছিলেন যে নেহেরু নাসের চৌ-এনলাইয়ের যুগ আর নেই। আজকের জগতে শক্তি আসে সম্মান আসে অর্থনীতির জোরেই। হয়তো একটা আশঙ্কাও ছিল উৎকণ্ঠাও ছিল যে এই অনুকুল বায়ু চিরকাল বইতে নাও পারে। তাই খুব কম সময়ে তিনি একশ'র বেশি দেশে সফর সেরে ফেললেন।

ওনার আশঙ্কা সঠিক প্রমাণিত হল। দেশের জিডিপিতে এল লাগাতার পতন। ঠেকাবার চেষ্টা হল না তা নয়। জিডিপি নির্ধারণে নতুন সিরিজ চালু করা হল। কিন্তু দেখা গেল তাতে ইউপিএ আমলের জিডিপিও বেড়ে গেল। আবার সংশোধন। এবার শুধুমাত্র মোদীর আমলে বৃদ্ধির হার বাড়ল। কিন্তু এভাবে কি হয়? দেশের সম্মান বাড়ল না। উল্টে দেশের পরিসংখ্যান দপ্তরের জগতজোড়া সুনাম নষ্ট হয়ে গেল। তাই মোদী যখন দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে এলেন তখন মনে হল বিদেশনীতি সম্বন্ধে উনি উদাসীন। নিঃস্পৃহ। বিদেশযাত্রা প্রায় বন্ধ। ওনার ঘনিষ্ট বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে পারলেন না। তাই কাশ্মীর হল। রামমন্দির হল। আগে ঝোঁক ছিল বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তির উপর। এবার নির্দেশ এল আত্মনির্ভর হও। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পর্ষদের স্থায়ী আসনের কথা আমরা বেমালুম ভুলে গেলাম।

কিন্তু মোদী সুযোগ না খুঁজলে কি হবে সুযোগ তো মোদীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্যান্ডেমিকের আকার ধারণ করল। সংক্রমণের উৎস হিসেবে চিহ্নিত হল চিনের উহান শহর। ট্রাম্প সাহেব চটে লাল। চিনকেই দায়ী করলেন সংক্রমণের জন্য। আর আমরা তো কবে থেকে বলছি চিন খারাপ। গোড়াতেই দেখা গেল উন্নত দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজনের বেশি টিকা সংগ্রহ করেছে। তৃতীয় বিশ্বের কি হবে? একমাত্র ভারতই পারে কম দামে ভ্যাক্সিনের জোগান দিতে। কিন্তু তার আগে দেশের মানুষকে টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হয়।

কয়েকটা রাজ্যে নির্বাচন আসন্ন। এদিক ওদিক ছোটখাটো নেতারা বললেন বিজেপি জিতলে টিকা ফ্রি। বিরোধীরা ভাবল এই বেলা চাপ দেওয়া যায় কেন্দ্রের উপর। দেশের সমস্ত নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হোক। ততদিনে নির্বাচন হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যসচিব পরিষ্কার বললেন সেরকম কোনও পরিকল্পনা নেই। দেখা গেল বিভিন্ন রাজ্যের সরকার টেন্ডার ডাকছে ভ্যাক্সিনের জন্য। এমন অব্যবস্থা যে সুপ্রিম কোর্ট বাধ্য হল হস্তক্ষেপ করতে। কেন্দ্রকে বাধ্য করা হল সবার জন্য ফ্রি টিকার ব্যবস্থা করতে। কিছুদিন মোদীর ছবি সহ পোস্টার দেখা যাচ্ছিল না। একদিন সেই পরিচিত মুখে অভয়বাণী শোনা গেল। সবার টিকা হবে।

কোয়াডের টোকিও মিটিঙে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভারতের টিকাকরণ প্রোগ্রামের জন্য মোদীর প্রশংসা করেছেন। শুনে মনে পড়ল বহু যুগ আগে সুপ্রিম কোর্ট তাজমহলকে বাঁচাবার জন্য একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই সময়ে কোর্ট সরকারের কাছে জানতে চান দিল্লির বাসে ডিজেল ব্যবহার না করে বাসগুলোকে সিএনজি-তে চালানো যায় কিনা। সরকার সঙ্গে সঙ্গে বলে অসম্ভব। একেবারেই অসম্ভব। জাস্টিস কুলদীপ সিং সরকারের কথায় কর্ণপাত না করে অর্ডার দেন দিল্লির সব বাস চলবে সিএনজিতে। কোনরকমে তার ব্যবস্থা করেই সরকার বিজ্ঞাপন শুরু করে 'সম্পূর্ণ পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানি চালিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পরিবহন বহর'। বিজ্ঞাপনে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেখা যায়নি।

একথা বলতে হয় যে, দ্বিধা কাটিয়ে শুরু করার পরে কেন্দ্রের টিকাকরণ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। এতো বড় মাপের কর্মসূচির সফল পরিচালনা সহজ নয়। ভক্তদের মতে এতো ভাল টিকাকরণ পৃথিবীতে কোথাও হয়নি। মোদী হয়ে গেলেন বিশ্বগুরু। কিন্তু টিকা তো সব নয়। মোদীর দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আর পাঁচটা উন্নত দেশের মতো বিমা ভিত্তিক। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে পরিকাঠামোর অভাব বেআব্রু করে দিল। নদীর জলে মৃতদেহ ভাসছে সে ছবি চেপে রাখা গেল না। এই ভয়াবহ ছবি নিশ্চয়ই ডব্লু.এইচ.ও.-কে ভক্তদের কীর্তনের চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তারা সরকারিভাবে জানাল ভারতে প্যান্ডেমিকে মৃতের সংখ্যা ভারত সরকারের সংখ্যার নয় গুণ। আগেই বলা হয়েছে ভারতের পরিসংখ্যান দপ্তরের প্রেস্টিজ বড় ধাক্কা খেয়েছে। তাই বিশ্বগুরু হবার কথা তোলা রইল।

প্যান্ডেমিক যেতে না যেতেই শুরু হল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেনে ভারতের বহু ছাত্র-ছাত্রী মেডিকেল পড়তে যায়। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তারা সমস্যায় পড়ে। তাদের দেশে ফেরানোর দাবি ওঠে। প্যান্ডেমিকে সরকার ইউরোপ আমেরিকা থেকে ভারতীয়দের উদ্ধার করেছিল 'বন্দে ভারত' ফ্লাইট চালু করে। প্রচুর হাততালি পাওয়া গেছিল। তাতে অবশ্য দেশে সংক্রমণ বাড়ে। কিন্তু সেটুকু ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন মোদী। ট্রাম্প সাহেবের সম্বর্ধনা আটকায়নি। কুম্ভমেলাও আটকায়নি। সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল শুধু পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর বেলায়।

যুদ্ধের কারণে কিন্তু ইউক্রেন থেকে ছাত্রদের ফেরানো সহজ হল না। ভক্তরা বললে, ওদের ফেরাবার দরকার কি? ওরা তো দেশের মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার যোগ্য নয় বলে গেছে বিদেশে। কিছুদিন পরে অবশ্য সম্ভব হল প্লেন পাঠিয়ে তাদের তুলে আনা। তখন এক এক দিন এক এক মন্ত্রী এসে তাদের স্বাগত জানালেন আর মোদীকে ধন্যবাদ।

যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৪শে ফেব্রুয়ারি। ৫ই মার্চ রাষ্ট্রসংঘে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করে প্রস্তাব আনা হল। ভোটে দেখা গেল ১৪১ সদস্য পক্ষে আর ৫ সদস্য বিপক্ষে। ভারত ভোটদানে বিরত থাকল। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী দেশগুলোর আনা এই প্রস্তাবে রাশিয়াকে যে ভাষায় নিন্দা করা হয়েছিল তা মোটেও সমর্থন যোগ্য ছিল না। সব দোষই যেন রাশিয়ার। কাজেই ভারতের ভোট না দেওয়া যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত হয়। দ্বিতীয় বারের ভোটেও ভারত বিরত থাকে। তাও মনে হয় অসংগত হয়নি। কিন্তু আগ্রাসনের নিন্দায় একটা কথাও না বলা কি উচিত হল? মোদী ফোনে পুতিন, জেলেনস্কি দুজনের সঙ্গেই কথা বলেছেন। ধরে নেওয়া যায় চেষ্টা করেছেন দু'পক্ষকেই বিরত করতে। কিন্তু নেটো রাশিয়ার দোরগোড়ায় উপস্থিত হওয়াতে পুতিন যতই উদ্বিগ্ন হোন না কেন ইউক্রেনের উপর হামলা অনুচিত হয়েছে। একথা একবারও বলা গেল না?

স্বীকার করতেই হবে যে, রাশিয়া আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। বহুযুগ ধরে আমরা রাশিয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করছি। আমাদের ফাইটার বিমান, সেই বিমান বহনকারী জাহাজ, পরমানবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন ট্যাঙ্ক ইত্যাদির ৮৫% এসেছে রাশিয়া থেকে। এদের যন্ত্রাংশ নিয়মিত আসে সেই দেশ থেকেই। কাজেই রাশিয়ার উপর আমরা পুরোপুরি নির্ভরশীল। কয়েক বছর হল এই নির্ভরতা কমাবার চেষ্টা হয়েছে আমেরিকা, ফ্রান্স, ইজরায়েল আর ব্রিটেন থেকে আমদানি বাড়িয়ে, কিন্তু তা সহজ হয়নি। আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য চাই দীর্ঘ প্রস্তুতি।

রাশিয়ার কাছ থেকে বহুদিন ধরেই আমরা অপরিশোধিত তেল কিনি। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে আমরা এখনও রাশিয়ার কাছে তেল কিনছি। এবং তাতে যথেষ্ট লাভবান হচ্ছি কারণ রাশিয়ার তেলের দাম এখন কম। এর আগে আমেরিকা ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আমরা কিন্তু তেল কেনা বন্ধ করিনি। এক্ষেত্রেও মাথা নত করার প্রশ্ন ওঠে না। ইউরোপের দেশগুলি রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে। কই তা তো নিষিদ্ধ হয়নি? মোদী বলবেন আমি নেহেরু নই। আমার নীতি বলিষ্ঠ নীতি। এতে আবেগ নেই ভাবালুতা নেই। এ শুধু দেশের স্বার্থে জাতির স্বার্থে।

তাহলে 'রুল বেসড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার'-এর কি হবে? সব দেশ শুধু নিজের স্বার্থ দেখবে? নিয়ম নীতি থাকবে না? মোদী পুতিনের জগতে সেটাই নিয়ম। সেটাই নীতি। বলা বাহুল্য এ শুধু বিদেশ নীতির বেলায় নয়। দেশের অভ্যন্তরেও প্রযোজ্য। রাশিয়ার অস্ত্র আমাদের দরকার রাশিয়ার তেল আমাদের দরকার। তার চেয়ে বড় দরকার রাষ্ট্রনায়কের ইমেজ তৈরি করা। আজ ইউক্রেন আমেরিকার সাহায্যে রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কাল আমাদের পড়শি অন্য এক সুপার পাওয়ারকে ধরে ভারতকে চ্যালেঞ্জ করলে? তাই ইউক্রেনের কি বক্তব্য তাদের কি অধিকার সে বিষয়ে মনে হয় না মোদী খুব গভীরে গিয়ে ভেবেছেন।

চিন আমাদের মস্ত মাথাব্যাথা। তায় সন্দেহ নেই। শি-জিনপিঙ্গের সঙ্গে মোদী আঠারো বার মিটিং করেছেন। তাতে যে বিশেষ কাজ হয়নি তা বোঝা গেল গলওয়ান উপত্যকার ঘটনায়। ভক্তেরা অবশ্য বলল, চিন এমন মার খেয়েছে আর এমুখো হবে না। কিন্তু ভগবান ভক্তের কথায় ভোলেননি। আমেরিকা এবং নেটোর আগ্রাসী নীতির ফলে রাশিয়া চিন-নির্ভর হয়ে পড়লে আমাদের সমূহ বিপদ তা তিনি মাথায় রেখেছেন। ভক্তেরা এও বলেছিল যে ডলারের যুগ শেষ। এবার রাশিয়া-ভারত-চিন ঠিক করবে কোন কারেন্সিতে তেল কেনা হবে।

মোদী কিন্তু দুই নৌকাতেই পা রেখেছেন। আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আমরা কোয়াডেও আছি। সক্রিয়ভাবে আছি। তাতে চিন বিচলিত হয়েছে তেমন কোনও খবর নেই। চিন-তাইওয়ান যুদ্ধের সম্ভাব্যতা বাড়ছে। ওদিকে ইউক্রেনের পরে ফিনল্যান্ড আর সুইডেন এখন নেটোর সদস্য হতে চায়। আমেরিকা নিশ্চয়ই তাই চায়। রাশিয়া বলেছে ফল ভাল হবে না। ছোট করে একটা পরমানবিক যুদ্ধ বোধ হয় লাগল বলে। বিশ্বগুরু সব কি করে সামলাবেন সেটাই এখন দেখার।