আরেক রকম ● দশম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২২ ● ১৭-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

আমার রবীন্দ্রনাথ ১৪২৯

অমিয় দেব


।। ১ ।।

ক'দিন ধরেই কিছু কবিতার লাইন মাথায় ঘুরছে, সেই কবে কৈশোরে প্রথম পড়েছিলাম। শুধু পড়িইনি, কন্ঠেও ধরে রেখেছিলাম - তা তখন অন্যদের শোনাবারও নির্বন্ধ হত কখনো সখনো। এতদিন যে ওই লাইনগুলির কথা ভাবিনি তা নয়। মাঝে মাঝেই ভেবেছি। আবার তাদের নিয়ে হয়তো গুরুগম্ভীর উক্তিও করেছি। কিন্তু এমন কখনো হয়নি। আজ ঊননব্বইতে কি তারা আমার স্মৃতির দখল নিতে এল! যখন খুশি গুঞ্জন করে উঠছে। না, ‘গগনে গরজে মেঘ’ নয়, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’। 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ'। [স্কুলপাঠ্যের বাইরে] আমার প্রথম রবীন্দ্রনাথ।

আমার অকালমৃতা কিশোরী দিদি ‘হেনাকে দিলাম’ লেখা এক ‘সঞ্চয়িতা’ একবার বাড়ির একমাত্র বইয়ের আলমারিতে আবিষ্কার করলাম। ‘রচনাবলী’ তখন বহু বাড়িতেই স্বপ্ন, ‘সঞ্চয়িতা’ই আমাদের রবীন্দ্রকাব্যের আকর। (বুদ্ধদেব বসুর “রবীন্দ্র রচনাবলী” গল্পে উচ্চমধ্যবিত্ত গৃহসজ্জায় রচনাবলীর প্রদর্শন-সংক্রান্ত ব্যঙ্গও এ-প্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে।) তাছাড়া, আমাদের পাণ্ডববর্জিত মফস্বলে ‘রবিঠাকুর’-এ অত্যধিক কৌতূহলও কোনও কিশোরের পক্ষে কিঞ্চিৎ অকালপক্বতার সামিল। মাঝে মাঝেই শুনতে হত, যা পড়ছ তা কি বুঝতে পারছ? নাকি শব্দের রণনেই মুগ্ধ থাকছ? আর ভাসছ ভাবের টানে, বস্তুর তোয়াক্কা না করেই? ফলে ‘সঞ্চয়িতা’-র সঙ্গে যে-সম্পর্ক আমার তখন তৈরি হল তা অনেকটাই একান্ত।

কিন্তু আমার এ-গল্প তো আসলে তখনের নয়, এখনের। এই কৈশোরক পুনরুজ্জীবন কি আমাকে আসন্ন দ্বিতীয় শৈশবের হাত থেকে রক্ষা করতে যাচ্ছে? ১৪২৯-এ ভরসা রাখব?

।। ২ ।।

এই গুঞ্জনের মধ্যেই আবার পড়লাম তাঁর শেষ ছাপা ভ্রমণকাহিনি ‘পথের সঞ্চয়’, যদিও সে-ভ্রমণ অনেক আগেকার - ১৯১২-১৩-র বিলেত-আমেরিকার, যা ঐতিহাসিক হয়ে উঠেছিল। পড়লাম তো বটে, কিন্তু ‘পথের সঞ্চয়’ কোন পাঠ? যা রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে সত্ত্বেও অজিত চক্রবর্তীর সম্পাদনা করা হয়ে ওঠেনি, এবং যা শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ নিজেই তৈরি করেছিলেন ১৯৩৯-এ? আর করেছিলেন “যাত্রার পূর্বপত্র” সহ তাঁর ওই ভ্রমণকালীন ২২টি সাধুভাষায় লেখা রচনা যা সঙ্গে সঙ্গে পত্রপত্রিকায় বেরোচ্ছিল, তা থেকে ১৩টি বেছে নিয়ে তা প্রভূত পরিমার্জনা ও চলিত ভাষায় রূপান্তরিত করে, সেইসঙ্গে তাঁর ১৯২০-র ইউরোপ-যাত্রার তিনটি ছোটো বিবরণকে একত্রে একটি রচনারূপে, এবং ‘পরিশিষ্ট’ অংশে ১৯১২-১৩-য় তাঁর শান্তিনিকেতনে লেখা ৭টি চিঠি, যোগ করে। (এই গল্প আরো বিশদ - ‘রবীন্দ্রনাথ ১২৫’ উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত ‘রচনাবলী’-র ১৬ নম্বরে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থপরিচয়ে তা আছে।) কিন্তু বিশ্বভারতী প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণ সেই প্রথম সংস্করণকে আড়াল করে দিল।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ছ-বছর পর, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে, ‘পথের সঞ্চয়’-এর যে-দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয়, এবং বিশ্বভারতী রচনাবলীর ষড়বিংশ খণ্ডে যা সন্নিবিষ্ট হয়, তার পাঠ রীতিমত ভিন্ন। তা ভ্রমণকালীন লেখা ও ছাপা ওই ২২টি সাধুভাষার আদি রচনায় ফিরে গেল। কেবল ওই ২২টিই, রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক যুক্ত ১৯২০-র ইউরোপ-যাত্রার বিবরণ ও ৭টি পত্রসংবলিত ‘পরিশিষ্ট’ বাদ গেল। এই নূতন পাঠ (বস্তুত পুরোনো পাঠ) ১৯৬১-তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত জন্মশতবার্ষিক রচনাবলীতেও গৃহীত হল। এটাই কি তাহলে ‘পথের সঞ্চয়’-এর মান্য পাঠ? কিন্তু প্রথম সংস্করণের স্মৃতি যাঁদের আছে তাঁরা কি তা পুরো মানবেন? রবীন্দ্রনাথের বর্জন, মার্জনা ও যোজনার কি কোনও দাম নেই?

দাম যে আছে তার প্রমাণ পাওয়া গেল পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরই ‘রবীন্দ্রনাথ ১২৫’-এর রচনাবলীতে। তার দ্বাদশ খণ্ডের সম্পাদকমণ্ডলী প্রথম সংস্করণে ফিরে গেলেন, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ১৩ + ১ + ‘পরিশিষ্ট’ পুনর্বহাল করলেন; তবে সেইসঙ্গে এক ‘সংযোজন’ও করলেন। রবীন্দ্রনাথ বর্জিত ৯টির ৭টি তাতে এল - আদিরূপেই। আদি ২২টিতে ২টি ছিল শিক্ষা বিষয়ক; তারা গেল ‘শিক্ষা’ গ্রন্থে। ‘১২৫’-এর এই পাঠে কি ‘পথের সঞ্চয়’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণের এক যুগ্ম স্বাদ পাওয়া গেল? একে কি মান্য পাঠ বলবার কোনও অবকাশ আছে? যদি থাকে, তাহলে হয়তো কারো কাছে মান্যতর মনে হবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরই ‘সার্ধশতবার্ষিক’ রচনাবলীর ঊনবিংশ খণ্ডে অন্তর্ভূত ‘পথের সঞ্চয়’-এর পাঠকে। কারণ তাতে ‘১২৫’-এর ওই ‘সংযোজন’ নেই - তা হুবহু প্রথম সংস্করণ অনুগামী, ১৩ + ১ + ‘পরিশিষ্ট’।

অতএব ‘পথের সঞ্চয়’-এর পাঠ এখন তিনটি - [পুনরুজ্জীবিত] রবীন্দ্রনাথ-কৃত ও বিশ্বভারতী-প্রকাশিত প্রথম সংস্করণের, বিশ্বভারতীরই ছাপা দ্বিতীয় সংস্করণের, আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ ১২৫’-এর দুই সংস্করণের যুগ্মস্বাদের। দ্বিতীয় সংস্করণের ওই আদি ২২টির সঙ্গে যদি প্রথম সংস্করণের দুই যোজন, অর্থাৎ ১৯২০-এর ইউরোপ-যাত্রার এক বিবরণ ও ৭টি পত্রসংবলিত ‘পরিশিষ্ট’, একত্র হয়, তাহলে কি আরো একটি পাঠ মেলে? সার্বিক? অবশ্য তাতে রবীন্দ্রনাথের পরিমার্জনার কোনও পরিচয় পাওয়া যাবে না। এমনি একটি পাঠ মাথায় রেখে তার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সোমদত্তা মণ্ডল, আর ২০১৮-তে তা দিল্লির নিয়োগী বুক্‌স ছেপেছে, 'Gleanings of the Road'. ‘পথের সঞ্চয়’-এর আর কোনও ইংরেজি অনুবাদ আছে বলে জানি না। তবে ১৯৬১-তে অমিয় চক্রবর্তী সম্পাদিত 'A Tagore Reader'-এ, তাঁরই করা প্রথম সংস্করণভুক্ত 'ইংলন্ডের পল্লীগ্রাম ও পাদ্রি' শীর্ষক রচনার ইংরেজি অনুবাদ ‘At a Village Parsonage in Staffordshire’  উদ্ধৃত হয়েছে। তা গোড়ায় বেরিয়েছিল 'Visva-Bharati Quarterly'-র ১৯৪০-এর গ্রীষ্ম সংখ্যায়।

।। ৩ ।।

লেখা একবার ছাপা হয়ে গেলে তা কতটা লেখকের কতটা পাঠকের, তা নিয়ে তর্ক আছে। তবে সেই তর্কের কোনও সহজ মীমাংসাও নেই। কারণ লেখকও তো তাঁর নিজের অতীত হয়ে যাওয়া লেখার পাঠক। আর সেই হিসেবে তো তাঁর পরে মনেই হতে পারে সেই লেখা পরিমার্জনসাপেক্ষ। তাঁর শিল্পী সত্তা তা বলতেই পারে। বিশেষ করে যে-বর্তমানে এসে সেই লেখা পড়ছেন তাঁর তৎকালীন লেখার প্রেক্ষিতে। অতীত বা ইতিহাসের একটা দাবি আছে বটে, এবং তাঁর পাঠক তা তুলতেও পারেন। যে-পাঠ সেই পাঠক পড়েছেন তা-ই তাঁর কাছে মান্য। অথচ, ‘সঞ্চয়িতা’-র ভূমিকায় যে-কথা রবীন্দ্রনাথ তুলেছিলেন তার যুক্তি বোধহয় আমরা অবহেলা করতে পারি না। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে কি 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' তার আদি পাঠে লেখকের কাছে মান্য থেকে যেতে পারে? থেকে যে যেতে পারে না তার প্রমাণই তো সেই লাইনগুলো যা আমার মনে গুঞ্জন করে চলেছে। যা আমার কৈশোরে আমি পড়েছিলাম। আমার প্রথম রবীন্দ্রনাথ।

১৯১২-১৩-র বিলেত-আমেরিকা ভ্রমণের লেখাগুলি যখন তিনি সংকলন করছিলেন তখন তিনি চলিত বাংলার ঈশ্বরপ্রতিম। ‘পথের সঞ্চয়’ যে-বছর বেরোল তার দু-বছর আগে বেরিয়েছে ‘বিশ্বপরিচয়’ ও এক বছর পরে বেরোবে ‘ছেলেবেলা’। তাঁর কাছে হয়তো তখন আর সাধু রচনার তেমন কদর নেই। অন্য দিকে ২২টি থেকে ১৩টি বেছে নেবার কারণ হতে পারে তারা ইংলন্ড-ভ্রমণ বিষয়ক। (১৯২০-র  যাত্রাকথাও ইংলন্ড-মুখী।) আমেরিকার কথা পাওয়া যাচ্ছে ‘পরিশিষ্ট’ভুক্ত ৭টি চিঠির পাঁচটিতে। অতএব, ‘পথের সঞ্চয়’-এর প্রথম পাঠের যৌক্তিকতা কি অনস্বীকার্য নয়?


(কৃতজ্ঞতাঃ মৌ দাশগুপ্ত, প্রণব বিশ্বাস, সৌরীন ভট্টাচার্য, স্বপ্না রায়।)