আরেক রকম ● দশম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২২ ● ১৭-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

সমসাময়িক

জ্ঞানবাপী, আদালত ও ধর্মনিরপেক্ষতা


সংঘ পরিবারের প্রত্যক্ষ উস্কানি এবং মদতে গোটা দেশজুড়ে এক ভয়াবহ চিন্তাকে বাস্তবায়িত করার অভিপ্রায়ে একের পর এক মামলা দাখিল করা হচ্ছে আদালতে। বেনারসের কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সংলগ্ন জ্ঞানবাপী মসজিদে হিন্দুদের প্রার্থনা করতে দেওয়ার আবেদনের প্রেক্ষিতে নিম্ন আদালত মসজিদে সমীক্ষা চালানোর মঞ্জুরি দেয়, যার পরে সেখানে শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে বলে রটানো হচ্ছে, আসলে যা একটি ফোয়ারা বলে দাবি মুসলমান পক্ষের। একই সময় মথুরার শ্রীকৃষ্ণ মন্দির সংলগ্ন ইদগা মসজিদও হিন্দু মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয়েছে বলে সেই মসজিদ নিয়েও মামলা দাখিল করা হয়েছে। তাজমহলকে শিব মন্দির প্রমাণিত করার অভিপ্রায় বহু বছর সংঘ পরিবার লালন করে আসছে। এখন তাজমহল নিয়েও মামলা দায়ের করা হয়েছে। আবার দিল্লির কুতুব মিনার সংলগ্ন চত্বরে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে বলে সেখানেও হিন্দুদের পূজা করার অধিকার চেয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে দিল্লির একটি আদালতে।

২০১৯ সালে বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের জমি হিন্দু পক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার পরে অনেক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন উদারনৈতিক চিন্তক মনে করেছিলেন যে, এই রায় কতটা সঠিক তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার ঘৃণ্য রাজনীতিতে ইতি টানবে সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। আসলে হয়েছে ঠিক তার উলটো। আমাদের দেশের উদারনৈতিক চিন্তকদের আরএসএস-বিজেপি সম্পর্কে মূল্যায়ন শিশুপাঠ্যের স্তরেই রয়ে গেছে। ১৯০০-৯২ সালে রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সময় থেকেই সংঘ পরিবার একটি স্লোগান প্রকাশ্যে দিয়ে এসেছে - ‘অযোধ্যা তো ঝাকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’। অর্থাৎ অযোধ্যার বাবরি মসজিদ দিয়ে শুরু হয়েছে হিন্দু মন্দির এবং হিন্দু অস্মিতার পুনরুত্থান, কাশী-মথুরা এখনও বাকি। উদারবাদীরা ভেবেছিলেন এটি নিছক কথার কথা। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে যে সংঘ পরিবারের কোনো কথাই কথার কথা নয়। তারা সোচ্চারে বিগত বহু বছর ধরে কাশী-মথুরাকে কেন্দ্র করে যা বলেছে, বর্তমানে তা কার্যকর করতে তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

প্রশ্ন হল তাদের এই দাবি কতটা যৌক্তিক? এর উত্তরে ইতিহাস ঘেঁটে কোনো লাভ হবে না। বিপুল এই দেশের সুদীর্ঘ অতীতে বহু ঘটনা ঘটেছে যা ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। সেই ইতিহাসে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাতের নানা সাক্ষ্য রয়েছে। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যের দ্বন্দ্ব সেই ঘাত-প্রতিঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু ইতিহাসে কোনো মন্দির ভেঙে যদি মসজিদ গড়া হয়েও থাকে, তাহলেও বর্তমানে সেই মসজিদকে ভেঙে ফেলার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। ভারতে থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ ও রাজাদের দ্বারা অত্যাচারিত বৌদ্ধরা যদি তাদের পূর্ব মর্যাদা ফিরে পাওয়ার দাবি জানায়, তবে তা যেমন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, তেমনি ঔরঙ্গজেব বা অন্য কোনো মুসলমান রাজা যদি কোনো হিন্দু মন্দির ভেঙেও থাকে, তবে তার প্রতিশোধ হিসেবে বর্তমানে মুসলমানদের মসজিদ ভেঙে ফেলতে হবে এই মনোভাব শুধুমাত্র বর্বরতার নিদর্শন, ধর্মের নয়।

ইতিহাসকে পিছনের দিকে চালানো যায় না। ইতিহাসের বহু ঘটনা আমাদের পছন্দ নয়। কিন্তু তার প্রতিশোধ বর্তমানে নেওয়া যায় না। যেমন ভারত ব্রিটিশদের হাতে ২০০ বছর পরাধীন ছিল বলে এখন ভারতীয়রা এই দাবি করতে পারে না যে, ব্রিটেনকে আগামী ২০০ বছর ভারতের উপনিবেশ হিসেবে থাকতে হবে। ইতিহাসের আবহমান কালে যারা মন্দির বা মসজিদ ভেঙেছে তারা কালের নিয়মেই এই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে। তাদের কৃতকর্মের জন্য বর্তমান আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে অন্য ধর্মের উপাসনা স্থলকে ভেঙে ফেলা বা তাকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তর করা নিছক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ব্যতিরেকে আর কিছুই নয়। এই রাজনীতির মূল লক্ষ্য ভোট লাভ করা, ধর্মের সেবা করা নয়। এই কথা জনগণ যত তাড়াতাড়ি বোঝেন ততই দেশের মঙ্গল হবে।

বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমি বিবাদের সময়, ১৯৯১ সালে ভারতে উপাসনাস্থল সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে বলা হয় যে, ভারতে অবস্থিত সমস্ত ধর্মীয় উপাসনাস্থল ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ যেই ধর্মের উপাসনাস্থল হিসেবে স্বীকৃত ছিল, সেই ধর্মের উপাসনাস্থল হিসেবেই স্বীকৃত থাকবে। কোনো অবস্থাতেই এই উপাসনাস্থলের চরিত্র পরিবর্তন করে অন্য কোনো ধর্মের উপাসনাস্থলে পর্যবসিত করা যাবে না। শুধু তাই নয়, এই পরিবর্তনকামী কোনো মামলা আদালতে গ্রাহ্য হবে না। এর একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমির কথা আইনে বলা হয়। ২০১৯ সালে বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত রায়ে, সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ ১৯৯১ সালের এই আইন নিয়ে ১০ পাতার আলোচনা করে। এই আলোচনায় সুপ্রিম কোর্ট এই মত প্রকাশ করেন যে এই আইন ভারতের সংবিধানের যে মৌলিক ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র তাকে রক্ষা করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ।

অথচ এই আইন এবং সুপ্রিম কোর্টের এই রায় থাকা সত্ত্বেও একের পর এক আদালতে বিভিন্ন উপাসনা স্থলের চরিত্র পরিবর্তন চেয়ে মামলা গৃহীত হচ্ছে এবং জ্ঞানবাপীর ক্ষেত্রে আদালত সমীক্ষা করার অনুমতিও দিচ্ছে। এবং আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম যে সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতের এই অতিসক্রিয়তার উপর লাগাম পরাচ্ছে না, ১৯৯১ সালের আইনকে উদ্ধৃত করে এই সমস্ত মামলাকে বেআইনি ঘোষণা করছে না। সুপ্রিম কোর্টের এই দ্বিধা, জ্ঞানবাপীর ক্ষেত্রে সমীক্ষার উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করা, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে।

আসলে জ্ঞানবাপী মসজিদ সংক্রান্ত মামলা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সামনে একটি বড়সড় প্রশ্ন চিহ্ন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সংঘ পরিবারের ঘোষিত কর্মসূচী কাশী-মথুরার মসজিদ, তাজ মহল ইত্যাদি মুসলমানদের তৈরি স্থাপত্যকে মন্দিরে পরিবর্তিত করা। এই কর্মসূচী সরাসরি ফ্যাসিবাদী, মুসলমান বিরোধী এবং ভারতের আইন তথা সংবিধানের বিরুদ্ধে। ভারতকে যদি আগামীদিনে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে হয় তবে এই পরিবর্তনগুলি করাই হবে সংঘ পরিবারের প্রধান কাজ। প্রশ্ন হল মহামান্য আদালত কী পারবে হিন্দু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বাঁচাতে? নাকি মানুষের বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে তারা আবারও হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের সামনে নতজানু হবেন, যেমন তারা হয়েছিলেন রাম মন্দির সংক্রান্ত মামলায়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আবার অগ্নিপরীক্ষার সময়। আদালত কী সংবিধানের রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করবে, নাকি সংখ্যাগুরুবাদের দাপটে নতিস্বীকার করে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অন্তর্জলী যাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা করবে।

আমরা ভরসা রাখতে চাই আদালত ও বিচার ব্যবস্থার উপর। অনেক ত্রুটি ও বিচ্যুতি সত্ত্বেও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বহুবার দেশের সরকারকে বাধ্য করেছে অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া অথবা আইনকে বাতিল করতে। কিন্তু আমরা শঙ্কিত হই যখন দেখি বিজেপির সভাপতি জ্ঞানবাপী মসজিদের মামলায় আদালতের উপর ভরসা রাখছেন বলে বয়ান জারি করেন। এই হল সেই বিজেপি যারা বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিবাদে ঘোষিত অবস্থান নিয়েছিল যে আদালত নয়, মানুষের বিশ্বাসের উপরেই তারা ভরসা রাখেন এবং আদালতকেও মানুষের বিশ্বাস মেনেই বাবরি মসজিদের জমি হিন্দুদের হস্তান্তর করা উচিত। সেই বিজেপি বাবরি মসজিদ মামলা আদালতে জিতে আবার জ্ঞানবাপীর ক্ষেত্রেও যখন আদালতের উপর ভরসা রয়েছে বলে বয়ান দেয়, তখন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির এই আশঙ্কা হওয়া স্বাভাবিক যে তবে কি আদালত সংখ্যাগুরুবাদের কাছেই মাথানত করবে? এর উত্তর নির্ধারিত করবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভবিষ্যৎ।