আরেক রকম ● দশম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২২ ● ১৭-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

সমসাময়িক

বন্যা এবং বুলডোজার


গ্রামের নাম সালনবাড়ি। থানা বটদ্রবা। জেলা নগাঁও। গত ২০শে মে থেকেই এখানে ঘটে চলেছে একের পর এক ঘটনা অথবা অঘটন।

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগে ২১শে মে শনিবার বিকালে অসমের বটদ্রবা থানায় আগুন লাগিয়েছিল একদল বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী৷ পরের দিন রবিবার সকালে থানা পোড়ানোর অজুহাতে ‘অভিযুক্ত’দের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিল আসামের পুলিশ৷ এবং অবশ্যই বাদ যায়নি পুলিশের হেফাজতে সদ্যমৃত ব্যক্তির বাড়িঘর।

পুলিশের স্পেশাল ডিজি রবিবার বটদ্রবায় গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে মন্তব্য করেন থানায় আগুন দেওয়া, নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলা মোটেও ক্ষোভের তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ নয়৷ তাঁর মতে এ আসলে সুযোগ বুঝে কিছু দুষ্কৃতীর ষড়যন্ত্রমূলক কীর্তিকলাপ। এর পেছনে জেহাদি যোগ রয়েছে বলেও তাঁর দাবি। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়৷ আরও ১৪-১৫ জন থানায় আটক৷ জেহাদি বা কোনও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে অভিযুক্তদের সম্পর্কের তথ্য মিললে তাদের বিরুদ্ধে নতুন ধারা যুক্ত হবে বলে আগাম জানিয়ে রেখেছেন পুলিশের স্পেশাল ডিজি।

থানায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়৷ একই ভাবে অভিযুক্তদের বাড়িঘরে বুলডোজার চালানো মানবাধিকারের প্রত্যক্ষ লঙ্ঘন৷ এহেন প্রতিশোধপরায়ণতা বাস্তবে পুলিশ ও অভিযুক্তদের একই স্তরে নামিয়ে দিয়েছে।

নিজের বক্তব্যকে জোরালো করতে গিয়ে স্পেশাল ডিজিপি বলেন, ওই এলাকায় বসবাসকারী কারও জমির পাট্টা নেই৷ দু'-চার জন পাট্টা দেখাতে পারলেও সেগুলি নাকি জাল৷ বেআইনি ভাবে জমি দখল করে এরা ওখানে নানা ধরনের অবৈধ কাজকর্ম চালিয়ে যায় বলেই তাঁর মন্তব্য। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ প্রসঙ্গে ডিজিপি জানিয়েছেন যে, বটদ্রবা থানার ওসিকে সাসপেন্ড করা হয়েছে৷ বাকি অফিসার-কর্মীরাও পুলিশি পরিভাষায় ক্লোজ্ড।

পক্ষান্তরে রাজ্যের পুলিশপ্রধান পুলিশ হেফাজতে মৃত্যূর অভিযোগ অস্বীকার করেন৷ তাঁর বক্তব্য, মদ খেয়ে হইচই করছিল মৃত ব্যক্তি। গ্রামবাসীদের অভিযোগ পেয়ে শুক্রবার রাতে তাকে বটদ্রবা থানায় তুলে আনা হয়৷ পর দিন সকালে তার স্ত্রীকে ডেকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ তখন স্ত্রীই তাকে কিছু খাওয়ানোর সময়ই নাকি সমস্যা দেখা দেয়৷ তাকে তখন পরপর দুই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি৷ মৃতের স্ত্রীর পাল্টা অভিযোগ, পুলিশ হেফাজতেই তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। জামিনের জন্য টাকা দাবি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।

বটদ্রবায় যা ঘটেছে এবং এখনও ঘটিয়ে চলা হচ্ছে তার সর্বশেষ উদাহরণ হল পুলিশের এনকাউন্টারে সতেরো বছরের এক ছাত্রের মৃত্যু। প্রশাসনের মতে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আশিকুল ইসলাম থানায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত। রবিবার ২৯শে মে আশিকুলকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের গাড়িতে চড়িয়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় আশিকুল নাকি পালিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তায় ঝাঁপ দেয়। এবং পিছনের গাড়িতে চাপা পড়ে তার মৃত্যু হয়। এমন সহজ সরল ভাষ্য নিবেদনের সময় প্রশাসনে কর্তব্যরত আধিকারিকদের খেয়াল ছিল না যে হাতকড়া পরিয়ে আশিকুলকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়েছিল। প্রতিটি এনকাউন্টার হত্যার ক্ষেত্রে একই যুক্তি প্রয়োগ করার জন্য প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।

পুলিশের হেফাজতে একটি মৃত্যু, পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় থানায় অগ্নিসংযোগ এবং তাৎক্ষণিক শাস্তি হিসেবে বুলডোজার চালিয়ে গ্রামবাসীদের বাস্তুচ্যুত করার প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য উন্মোচিত হয়েছে। আসামের প্রশাসনিক প্রধান রাজ্যের একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি নিত্যদিন উষ্মা-ক্ষোভ প্রকাশ করতে অভ্যস্ত। পড়ুয়াদের মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হলে তা 'মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমতুল' বলে তাঁর ধারণা। রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য তিনি বিশেষ শংসাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ২০২০-তে আসামের সমস্ত সরকারি মাদ্রাসা তুলে দিয়ে সেগুলিকে স্কুলে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। এতে নাকি ‘ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা’ গড়ে তোলার পথ সহজ হবে। যদিও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২০২১-এ গৌহাটি হাইকোর্টে ১৩টি আবেদন জমা পড়ে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।

খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে, আসামের মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবতঃ অন্যান্য রাজ্যে ক্ষমতাসীন তাঁর দলের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন। কেউ প্রকাশ্যে নমাজ পড়া বন্ধ করতে ব্যস্ত। কেউ আবার অবিলম্বে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্য্যকর করার পক্ষে জোরদার সওয়াল করছেন। অনেকে আবার রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী শান্তিতে ও নির্বিঘ্নে আয়োজন করতে পেরে আত্মসন্তুস্ট। পর্তুগিজ শাসনাধীন থাকাকালীন রাজ্যে নাকি অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল, এমন যুক্তি দিয়ে সেখানে এখন মন্দির পুনর্নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে। আর গো-মাতাদের সেবায় সকলেই নিয়োজিত প্রাণ। আসামের গোয়ালপাড়া জেলার এক স্কুল শিক্ষিকা টিফিন বাক্সে গো-মাংস আনার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঘুরে ফিরে সেই স্বৈরাচারী তত্বের প্রয়োগঃ নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রক্রিয়া রাষ্ট্র নির্ধারণ করে দেবে।

অথচ এই মুহূর্তে আসামের তেত্রিশটি জেলার মধ্যে ঊনত্রিশটি বন্যা কবলিত। ডিমা হাসাও এবং কার্বি আংলং জেলা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত আড়াই হাজারের বেশি গ্রাম। ৬ লক্ষ মানুষ প্রভাবিত। ৩৪৩টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে রাজ্যে। সেখানে প্রায় এক লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বাদবাকিরা? প্রশাসন নীরব।

বন্যাকবলিত আসামের যমুনামুখ জেলার দুই গ্রাম চাংজুরাই এবং পাটিয়া পাথরের বাসিন্দারা বন্যায় ঘরবাড়ি, জমি হারিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন রেললাইনের উপর। ভরসার বিষয় বন্যার দাপটে ট্রেন চলাচল আপাততঃ বন্ধ। মাথা ঢাকার মতো কিছু নেই। খোলা আকাশের নীচে আতঙ্কে দিন-রাত কাটাচ্ছেন তাঁরা। খাবার বলতে সে রকম কিছুই জুটছে না তাঁদের। পানীয় জলও পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ, সরকারি সাহায্যও মিলছে না ঠিক মতো। চার-পাঁচ দিন পর স্থানীয় প্রশাসনের তরফে কিছু চাল, ডাল এবং তেল দেওয়া হয়। কেউ পেয়েছেন, কেউ আবার পাননি। এবং কোন জ্বালানি দিয়ে রান্না করা হবে তা-ও কেউ জানে না। ফলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো স্বচ্ছ ধারণা আছে কি? রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা কীভাবে কত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে কোনো কথা শোনা যায়নি। রাজ্যের কয়েকজন মন্ত্রী বন্য বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু পরিত্রাণের কোনো দিশা দেখাতে পারেননি। মুখ্যমন্ত্রী নিয়মিত দিল্লি যাচ্ছেন। এবং ধর্মীয় মেরুকরণের নতুন নতুন উপদেশ নিয়ে গুয়াহাটিতে ফিরে আসছেন। মসজিদ, মাদ্রাসা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে তাঁর উৎসাহ আছে কিনা বলা মুশকিল। কারণ, অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনার কথা তাঁর বিবৃতিতে প্রকাশিত হয় না। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই সঙ্কটকালে অন্ততঃ বার দুয়েক আসামে এসেছেন। বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন সম্ভবতঃ তাঁর সফরসূচিতে ছিল না। বন্যা অথবা বুলডোজার নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

কথায় কথায় বিশ্বাস-বিকাশ প্রসঙ্গে বিবৃতি দিতে যাঁরা অভ্যস্ত, সরকারের জন্মদিন পালন করতে যাঁরা ব্যস্ত তাঁরা কি বন্যা কবলিত আসামের ঊনত্রিশ জেলার বাস্তুচ্যুত মানুষের জীবন নিয়ে আদৌ চিন্তিত? দেশের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, তিনি ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের কোনায় কোনায় কোথায় কখন কী ঘটছে তার উপরে নজর রাখেন। তাঁর ড্রোন কি রেললাইন উপড়ে যাওয়ার ছবি দেখায় না? বন্যা কবলিত অসহায় মানুষের অবস্থা কি তাঁর ড্রোনের নজরে আসে না? বানভাসি মানুষের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ছবি তোলার সময় কি তাঁর ড্রোন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়? তাহলে এত ঘটা করে রাষ্ট্ৰীয় নজরদারির খবর শুনিয়ে কী লাভ?

যন্ত্রের নজরে সবকিছু দেখা যাক অথবা না যাক তা বড়ো কথা নয়, মানুষের নজরে সবকিছুই ধরা পড়ছে এবং স্মৃতিতে জমা থাকছে। সময় মতো তার জবাব নিশ্চিতভাবে মানুষই দেবে।