আরেক রকম ● দশম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২২ ● ১৭-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

নির্লজ্জ সরকার, সীমাহীন দুর্নীতি


রাজ্যের রঙ্গমঞ্চে আবারও এক নতুন রঙ্গের অবতারণা। রাজ্যবাসী বিরক্তি ও কৌতূহল নিয়ে দেখছেন যে রাজ্যের শিক্ষাদপ্তরের কর্তা থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী, প্রাক্তন মন্ত্রী নিয়ম করে কলকাতার সিবিআই দপ্তরে হাজিরা দিচ্ছেন। এ রাজ্যে স্কুল শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি সম্ভবত মধ্যপ্রদেশের ব্যপম কেলেঙ্কারিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। যেভাবে একের পর এক নিয়োগ দুর্নীতির খবর নিত্যদিন সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে তাতে একথা বলাই যায় যে, রাজ্য সরকার সফলভাবে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটাতে পেরেছে। আর গোটা ঘটনায় রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় আমলা বা মন্ত্রীদের নাম উঠে আসা এটাই প্রমাণ করে যে, এই দুর্নীতির শিকড় গোটা প্রশাসনের এক সাধারণ বৈশিষ্টে পর্যবসিত হয়েছে এবং তার সফল কেন্দ্রীকরণ ঘটেছে।

আজকে সাংবাদিকদের সামনে মাননীয়া যতই চিৎকার করে বলুন যে, আগের সরকারের আমলে শিক্ষাদপ্তরের নিয়োগে একই রকম দুর্নীতি হয়েছে, তাতে বর্তমান সরকারের দুর্নীতিস্পৃহা এতটুকু ন্যায্য হয়ে যায় না। বরং উলটে এই প্রশ্ন উঠে আসে যে, আজকে ১০ বছরেরও বেশি সময় সরকার পরিচালনার পরেও কেন তিনি পূর্বতন সরকারের আমলে ঘটা তথাকথিত দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করতে পারছেন না। রাজ্যের অভিভাবক হিসাবে এবং সরকারের প্রধান হিসাবে এ তো তার কর্তব্য, যে দুর্নীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছে সুবিচার পৌঁছে দেওয়া। এমনি কর্মসংস্থানের আকালে ভুগতে থাকা বাঙালি যুবসমাজের কাছে আশার প্রদীপ সবেধন নীলমণি কিছু সরকারী চাকরি। স্কুল শিক্ষার সরকারীকরণের পর এটিই সম্ভবত সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র যেখানে রাজ্য সরকার অনেক সংখ্যায় কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটাতে পারে। এহেন একটি ক্ষেত্রে যদি দুর্নীতি ঘটে থাকে তাহলে তো মাননীয়ার কর্তব্য ছিল, বদলের ডাক দিয়ে মসনদে বসার পর সেই দুর্নীতি উন্মোচন করে, এ রাজ্যের বেকার যুবক-যুবতীদের মুখে হাসি ফোটানো। কিন্তু বিগত ১০ বছর সময়কালে এরকম কোনো উদ্যোগ তাঁর সরকার নেয়নি। এর কারণ বোঝা কঠিন নয়। বিগত বাম সরকারের আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ সংক্রান্ত কিছু অনিয়ম হয়ে থাকলেও, কখনই তা বর্তমান সরকারের অনুপ্রেরণায় এক সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়নি। সরকারের শীর্ষ মন্ত্রীদের সিবিআই বা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা চুরির দায়ে অভিযুক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হয়নি বাম আমলে।

কিন্তু বর্তমানে রাজ্য সরকারের অধীনে যে কোনো নিয়োগ ঘিরেই দুর্নীতির অভিযোগ আজকে এক সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রই নয়, সরকারি তত্ত্বাবধানে যে কোনো নিয়োগ এমনকি ডব্লুবিসিএস নিয়োগ ঘিরেও দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে যা অত্যন্ত আশঙ্কার। যদি রাজ্যের প্রশাসনের শীর্ষস্তরের আমলা নিয়োগেই দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটে গিয়ে থাকে তাহলে এমন আমলাদের নজরদারিতে যে গোটা সরকারি ব্যবস্থাটাই দুর্নীতির কারখানা হয়ে উঠবে এ তো বলাই বাহুল্য। যেহেতু শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগের সংখ্যা বেশি এবং প্রার্থী সংখ্যা অন্য ক্ষেত্রের চেয়ে অনেক বেশি ফলে এখানে দুর্নীতির পরিমাণও বেশি। এক একটি নিয়োগ ঘিরে লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন যে হয়েছে আদালতের কার্যবিবরণী থেকে তা স্পষ্ট। শাসকদলের নীচুতলার কর্মী থেকে নেতৃত্ব, প্রশাসনের নীচ থেকে ওপরমহল অবধি দুর্নীতির এই ব্যাপক বিস্তার খোদ আদালতকেই বাধ্য করেছে রাজ্য প্রশাসনের হাত থেকে তদন্তভার সিবিআই এর হাতে তুলে দিতে। এমনকি আদালত তথ্য লোপাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে গুরুত্ব দিয়ে এসএসসি-র কার্যালয়ের পাহারার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের ওপর এই সার্বিক অনাস্থা আজ আর কেবল আমজনতা নয়, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির ভেতরেও সঞ্চারিত হয়েছে।

অবশ্য এরপরেও এই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও তার পরিচালকদের নির্লজ্জতা যাওয়ার নয়। কখনো দপ্তরের মন্ত্রীর মেয়ে আদালতের নির্দেশে স্কুলের চাকরি খুইয়ে পরক্ষণেই কলেজে অধ্যাপকের চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন, কখনো বা রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী অভিযুক্ত হয়ে বলছেন দুর্নীতির দায় তার একার না, বরং গোটা সরকারের, আবার কখনো বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী বলছেন এইসবের দায় তার নয়। কিন্তু অন্তত নৈতিক দায় নিয়েও এদের কাউকেই পদত্যাগ করতে দেখা যাচ্ছে না। সবাই যে যার পদ আঁকড়ে অন্যের ঘাড়ে দায় ঠেলতে ব্যস্ত। আর মাননীয়া, যার কথা ছাড়া প্রশাসন থেকে দলের কোনো কাজই হয়না তিনি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বসে অম্লানবদনে নিজের স্তবে ব্যস্ত। কখনো তিনি নিজেকে সাহিত্য চর্চার জন্য 'বাংলা আকাদেমি পুরস্কার' দিচ্ছেন, কখনো বা নিজেকেই রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের 'আচার্য' ঘোষণা করে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে তিনি ছাপান্ন ইঞ্চির পদাঙ্ক সফলতার সাথেই অনুসরণ করে চলেছেন। মাননীয়া যে বরাবরই দুর্নীতিগ্রস্তদের পৃষ্ঠপোষক তা আগেই প্রমাণিত। চিটফান্ড কেলেঙ্কারির সমস্ত কুশীলবেরা ওনার দলে ও প্রশাসনে পদ আলো করে রয়েছে। এমনকি সিবিআই যখন রাজ্য পুলিশের পূর্বতন কমিশনারকে দুর্নীতির তদন্তে গ্রেফতার করতে আসে তখন মাননীয়া তার সমর্থনে রাস্তায় ধর্না দিয়েছেন। এমনকি রাজ্যবাসীকে অবাক করে “আমরা সবাই চোর” লিখে প্রকাশ্য মিছিল করেছেন। এমন ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে সম্ভবত নজিরবিহীন।

আজকে এই দুর্নীতির তদন্তভার যে কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে গিয়েছে তাদের ইতিহাসও খুব উজ্জ্বল নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত মন্তব্য করেছিলেন যে, এই সংস্থার অবস্থা খাঁচায় বন্দী তোতাপাখির মত। কেন্দ্রের সরকার চাইলে তারা তদন্ত সমাধা করে, নয়ত তদন্ত অমীমাংসিতই থেকে যায়। সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্ত সেই সাক্ষ্যই বহন করে। আজ ৯ বছর কেটে গিয়েছে কিন্তু আজ অবধি এতে যুক্ত কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির শাস্তি হয়নি। এ রাজ্যের শাসকদলের একাধিক নেতৃত্বকে মাঝে মাঝেই সিবিআই বা ইডি ডেকে পাঠায়, তারা হাজিরা দেন আবার ফেরত এসে নিজেদের কাজ করতে থাকেন। তদন্ত চলতেই থাকে, কেউ দোষী সাব্যস্ত হয় না। তাই কেবল এই সংস্থার হাতে দায়িত্ব থাকলে রাজ্যের এই নিয়োগ দুর্নীতির সুবিচার দূর অস্ত। আদালতের নজরদারীতে তদন্ত চললে হয়ত কিছু ন্যয়বিচার মিলতে পারে। রাজ্যের মানুষের সোচ্চার প্রতিবাদ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

একথা অনস্বীকার্য যে, এ রাজ্যের জনগণও দীর্ঘদিন স্থবিরতার শিকার। নিয়োগ দুর্নীতি হোক বা ত্রাণ দুর্নীতি, সামাজিক প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ হোক বা চিটফান্ড কেলেঙ্কারিই হোক, আমজনতা নির্বিবাদে সব হজম করে নিতে শিখেছে। সারদা থেকে শুরু করে একের পর এক চিটফান্ড কেলেঙ্কারীতে যখন প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ প্রতারিত হয়েছেন, প্রতারণার অর্থের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি তখনও মাননীয়ার আমোঘ উক্তি ছিল, “যা গেছে তা যাক”। নারদা কেলেঙ্কারিতে যখন রাজ্যের মন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা ঘুষ নেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত তখনও মাননীয়া বলেছেন সবই চক্রান্ত। পরিস্থিতি এতই ঘোরালো হয়ে ওঠে যে তার পরে ২০১৬ সালে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারে মাননীয়াকে বলতে হয়, “আগে জানলে এদের টিকিট দিতাম না”, “২৯৪টি কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী” তখন রাজ্যের সিংহভাগ জনতা সেই কথামৃতকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এই সমস্ত দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদেরকেই হাত তুলে সমর্থন করেছেন। এই সমর্থনের নেপথ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল বিরোধী দলগুলি বিশেষ করে বামেদের ব্যর্থতা। ফলে আজ যে সেই দুর্নীতির নাগপাশ এই রাজ্যকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে এ আর কষ্টকল্পিত কেন হবে।

আশার কথা আদালতকে মানুষের ভরসাস্থলে হিসাবে বজায় রাখতে কিছু আইনজীবি, বিচারপতি আজও দায়বদ্ধ। তাই মাঝে মাঝে এমন ব্যাপক দুর্নীতির গোড়াতেও টান পড়ে। মানুষ সচকিত হয়ে দেখে যে, এমন সংঘবদ্ধ দুর্নীতির প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও ন্যয়বিচার পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কয়েকজন ব্যক্তি মানুষের পক্ষে এই লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রয়োজন বিশাল অংশের মানুষের সক্রিয় প্রতিবাদ। কেবল সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য বা চটকদার স্লোগানে এই প্রতিবাদ গড়ে উঠবে না। রাজপথে নেমে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ, নিরন্তর প্রচার ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা না গেলে এই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনকে পরাস্ত করা যাবে না। ছাত্র-যুব সমাজের একাংশ মাঝে মাঝে প্রতিবাদে সামিল হলেও সেগুলো সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারছে না। দরকার নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে বার করে এনে এই প্রতিবাদকে ছাত্র-যুব সমাজের এক ব্যাপক আন্দোলনে পরিণত করা। তবেই রাজ্যের রাহুমুক্তি ঘটবে।