আরেক রকম ● দশম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২২ ● ১-১৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ফরাসি নামের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণের কিছু সমস্যা

উদয়শংকর বর্মা


বিদেশি ভাষাগুলোর মধ্যে ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তার পরেই সম্ভবত ফরাসি ভাষা। উনিশ শতকের বাঙালি মনীষীরা অনেকেই ফরাসি ভাষা, দর্শন ও সাহিত্যের কাছে উদারভাবে গ্রহিষ্ণু। কেউ ইংরেজি অনুবাদের ভেতর দিয়ে, কেউ বা সরাসরি। তাছাড়া চন্দননগরে ফরাসি উপনিবেশও ছিল। আঠেরো শতকেই ওগুস্ত্যাঁ ওসাঁ বাংলা ফরাসি শব্দকোষ রচনা করেছিলেন। উনিশ শতক থেকে ফরাসি সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ ও বঙ্গীকরণ শুরু হয়েছে। বিশ ও একুশ শতকে তো কথাই নেই। সুতরাং ফরাসি শব্দের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণের বিষয়টি বেশ পুরনো। কিন্তু দীর্ঘদিনের ফরাসি চর্চা সত্ত্বেও একই শব্দের প্রতিবর্ণীকরণের বৈভিন্ন্য আজও রয়ে গেছে। এমনিতেই বাংলা ভাষার বানানে চারটি প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক ধারা। যথা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, বাংলাদেশ বাংলা একাডেমি, সংসদ বানান এবং আনন্দবাজারের বিশেষ বানানরীতি। ফলে বাঙালি লেখক, পাঠকেরা যথেষ্ট দিশাহারা! এর পরে বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ বা লিপ্যন্তরণে একই শব্দের যদি একাধিক রূপ শতফুলের মতো বিকশিত হতে থাকে, তাহলে এমনিতেই বাংলা ভাষার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া জাতির পক্ষে ব্যাপারটা কতটা আকর্ষণীয় হবে সে প্রশ্ন উঠবে বৈকি! যাই হোক, বাংলা ভাষায় একই ফরাসি শব্দের যে বিভিন্ন বানান প্রচলিত আছে, তা নিয়েই এ-প্রসঙ্গ। মূলত (ʒ), ( ɑ), (a), (ɛ), (j), (ɔ), (o) এবং (y) ধ্বনিবিশিষ্ট কিছু ফরাসি শব্দ (ব্যক্তি নাম) কীভাবে বাংলায় প্রতিবর্ণীকৃত হয়েছে, তা-ই দেখা হবে।

প্রথমে Jacque Prevert-। Jacque Prevert-কে বাংলা অক্ষরে অরুণ মিত্র এবং পলাশবরণ পাল লিখেছেন - ঝাক প্রেভের। Jean Jacques Rousseau নন্দদুলাল দে’র লিপ্যন্তরে হয়েছেন জাঁ জাক্‌ রুসো। Jean Paul Sartre-কে অরুণ মিত্র ঝাঁ পল সার্ত্র লিখলেও লোকনাথ ভট্টাচার্য এবং চিন্ময় গুহ প্রমুখেরা জাঁ পল সার্ত্র-ই লিখে থাকেন। নারায়ণ মুখোপাধ্যায় ও পুষ্কর দাশগুপ্ত লেখেন জঁ পল সার্ত্র। Jules Bloch-এর নাম সুনীতিকুমার চট্টোপাধায় বাংলায় লিখেছেন ঝ্যুল ব্লক। অরুণ মিত্র Saint John Perse-এর বঙ্গীয় রূপান্তর করেছেন স্যাঁ ঝন্‌ পের্স, নন্দদুলাল দে স্যাঁ জন প্যার্স। লোকনাথ ভট্টাচার্য স্যাঁ জন পের্স।

আমরা জানি যে, ফরাসি ‘J’ ব্যঞ্জনধ্বনিটির আন্তর্জাতিক উচ্চারণচিহ্ন হচ্ছে ʒ। সহজ করে বললে, এর উচ্চারণ হবে বাংলা 'জ' ধ্বনি এবং 'ঝ' ধ্বনির মাঝামাঝি। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে, “জ তদ্রূপ ইংরেজি ‘J’-এর মতো না হইয়া, dz বা Z-এর মতো হয় এবং Jh ‘ঝ’-এর মতো না হইয়া চাপা গলায় উচ্চারিত dz-এর মতো হয়।” (দ্রষ্টব্য - ভাষাপ্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ-এর ধ্বনিতত্ত্ব অধ্যায়)। ইংরেজি Pleasure শব্দের প্রতিবর্ণীকরণের জন্যে তিনি 'ঝ' বা 'বিন্দুচিহ্নিত ঝ' ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে জন্যেই তিনি Jules Bloch-কে লিখেছেন ঝুল ব্লক। অরুণ মিত্র Jacque-কে লিখেছেন, ঝাক, John-কে ঝন এবং আনুনাসিক Jean-কে লিখেছেন ঝাঁ। পলাশবরণ পাল Jacque-এর ক্ষেত্রে ঝ-এর নিচে বিন্দু চিহ্ন বসিয়েছেন সুনীতিকুমারের নিয়ম মেনেই। তাছাড়া Jacque শব্দটিতে শ্বাসাঘাতও রয়েছে। কিন্তু ফরাসিদের J তথা ʒ ধ্বনিটি dz-এর মতো উচ্চারণ করতে দেখা যায় না, Z-এর মতো করেই তা সাধারণত উচ্চারণ করতে দেখা যায়। সম্ভবত এ-কারণেই লোকনাথ ভট্টাচার্য, চিন্ময় গুহ প্রমুখ লেখকেরা জাক, জাঁ, জন ইত্যাদি বানান লিখেছেন।

এবার জাঁ অথবা জঁ-এর প্রসঙ্গে আসা যাক। এর সঙ্গে আরও অনেকগুলি নাম জড়িয়ে যাবে। যেমন, Andrè, François, Henry, Chateaubriand প্রভৃতি। বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবেই Jean-কে জাঁ, Andrè-কে আঁদ্রে, François-কে ফ্রাঁসোয়া, Henry-কে আঁরি, Chateaubriand-কে শাতোব্রিঁয়া লেখা হয়ে থাকে। লারুস, প্যতি রবের, অক্সফোর্ড-হাসেট প্রভৃতি বিখ্যাত অভিধানগুলিতে এই নামগুলির উচ্চারণ দেওয়া আছে এভাবে - Jean (ʒɑ̃), Andrè (ɑ̃drɛn), François (frɑ̃swa), Henry (ɑ̃ri), Chateaubriand (ʃatobrijɑ̃)। যাই হোক, এই নামগুলিতে আনুনাসিক ধ্বনির কোনও সমস্যা নেই, আছে আ (ɑ) এবং আ’ (a) স্বরধ্বনির প্রকৃতিগত সমস্যা। 'আ’ সম্মুখজিহ্ব (antérieur) স্বরধ্বনি আর 'আ' পশ্চাৎ-জিহ্ব (postérieur) স্বরধ্বনি। প্রথমটির উচ্চারণ প্রসারিত, দ্বিতীয়টির উচ্চারণ চাপা। উভয়ের মধ্যে এই সুনির্দিষ্ট পার্থক্যটি থাকলেও পূর্ব ও দক্ষিণ ফ্রান্সে এই ধ্বনিদুটির উচ্চারণ একই রকম। অন্যত্রও সব সময় এতদুভয়ের পার্থক্য রক্ষিত হয় না। সেজন্যেই Maurice Grevisse এবং André Goosse প্রণীত ফরাসি ভাষার বিখ্যাত ব্যাকরণগ্রন্থ Le Bon Usage-এ উক্ত আ (ɑ) এবং আ’ (a) ধ্বনিদুটিকে একটি ধ্বনিরূপেই গণ্য করার আবেদন জানানো হয়েছে। (Ce’st pourquoinous n’en avons pas tenu compte danse ce livre et nous avons représenté (a) et (ɑ) un signe unique?) তবে Le Bon Usage-এর এই আবেদনের উত্তরে এটুকুই বলা যায় যে, যতদিন ɑ এবং a ধ্বনিদুটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ত্ব বিদ্যমান থাকবে, ততদিন তা কী করেই বা সম্ভব? সেদিক থেকে বিচার করে (ɑ) চিহ্নিত ধ্বনিগুলিকে অ’কার, (আনুনাসিক হলে অঁ) এবং (a) চিহ্নিত ধ্বনিগুলিকে আ’ (আনুনাসিক হলে আঁ’)-কার বানানেই লেখা সঙ্গত। হয়তো তাই পুষ্কর দাশগুপ্ত উক্ত নামগুলিকে জঁ, অঁদ্রে, ফ্রঁসোয়া, অঁরি ইত্যাকার বানানে লিখেছেন। তাহলে একইভাবে Chateaubriand (ʃatobrijɑ̃) হওয়া উচিত শাতোব্রিয়ঁ। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে আর একটি বিষয়ও উল্লেখ করতে চাই। ফরাসি শব্দের শেষে (ɑ) বা (a) যে ধ্বনি-ই থাক, তাকে কীভাবে লেখা উচিত? যেমন, Chateaubriand-কে চিন্ময় গুহ লিখেছেন শাতোব্রিয়াঁ, লোকনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন শাতোব্রিআঁ। Napolion (napɔleɔ̃)-কে পলাশবরন পাল লেখেন নাপোলেঅঁ। চিন্ময় গুহ নাপোলেয়ঁ। (ɑ) বা (a)-কে কি য় বা য়া দিয়ে প্রকাশ করা যায় না? নাকি আদি মধ্যযুগের বাংলার মতো করেই শব্দের শেষে অ বা আ অক্ষরের প্রয়োগ করা বাধ্যতামূলক?

এবারে আসা যাক পের্স বনাম প্যার্স-এর যৌক্তিকতায়। এই সমস্যাটি ফরাসি (ɛ) ধ্বনিটির বঙ্গীয় রূপান্তরণ সংক্রান্ত। ডক্টর সুকুমার সেন এই ধ্বনিতাত্ত্বিক চিহ্নটিকে দেখিয়েছেন (এ’) রূপে। তিনি বলেছেন যে, যখন ‘দেশ’ শব্দটিকে ‘দ্যাশ’ উচ্চারণ করা হয় তখন এই ধ্বনিটিরই প্রয়োগ ঘটে। সেদিক থেকে ধরলে শুধু Perse-ই যে প্যার্স হবে তাই নয়, Voltaire (vɔltɛr) হবে, ভলত্যার, Baudelaire (bodlɛr) হবে বোদল্যার, Albert (albɛr) হবে আলব্যার, Flaubert (flobɛr) হবে ফ্লোব্যার এবং Madelaine (madlɛn) হবে মাদল্যান। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে এই রীতির ব্যাপক প্রয়োগ ঘটেছে। নন্দদুলাল দে-ও তাই করেছেন। ফাদার দ্যতিয়েন-ও Madelaine-কে মাদল্যান লিখেছেন। অরুণ মিত্র, পুষ্কর দাশগুপ্ত প্রমুখ লেখকেরা ভলতের, বোদলের, ফ্লোবের, আলবের, মাদলেন এরূপ লিখেছেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও মাদলেন লিখেছেন। Baudelaire (bodlɛr)-কে লোকনাথ ভট্টাচার্য এবং নারায়ণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, বোদলেয়ার। ফরাসিরা মৌখিক উচ্চারণেও বোদলেয়ারই বলেন। চিন্ময় গুহ Baudelaire (bodlɛr)-কে বোদল্যের লেখেন। প্রশ্ন উঠবেই যে, তাহলে সমরূপ ধ্বনি-সংগঠনের Grammaire [gra(m)mɛr] শব্দটিকে কি একইভাবে গ্রাম্যের লেখা যাবে? আর উভয় ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী কেউ যদি বোদোল্লের এবং গ্রাম্মের পড়েন তাহলেই বা কী হবে? কারণ, বাংলা ভাষায় য ফলা যুক্ত ধ্বনিটিকে অনেক সময়ই দ্বিত্ব উচ্চারণ করা হয়। যথা - সন্যাসী (সন্নাসী), বিদ্যা (বিদ্দা) ইত্যাদি।

Robespierre-নামটির মধ্যেও (ɛ) ধ্বনিটি আছে এবং নন্দদুলাল দে লিপ্যন্তরে তাকে (এ’) হিসেবেই গণ্য করেছেন। তাই লিখেছেন, রব্যাস্‌পিয়্যার। pierre-এর (ie)-কেও এ’ ধ্বনি হিসেবে মান্য করেছেন। কিন্তু (ie) আসলে একটি তরল স্বর (glide), যার ধ্বনিতাত্ত্বিক চিহ্ন (j) আর উচ্চারণ ইয়ে। যথা pierre (pjɛr) পিয়ের, ইয়ের প্রভৃতি। ফরাসি আকাদেমি অভিধানে Robespierre-এর উচ্চারণ দেওয়া আছে - ro-bè-spièr এবং চিন্ময় গুহ রবেস্‌পিয়ের-ই লিখেছেন। নন্দদুলাল দে (j) ধ্বনিটিকে Moliere-এর নামের ক্ষেত্রেও ‘ইয়ার’ হিসেবে উচ্চারণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, মলিয়্যার। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লোকনাথ ভট্টাচার্য Moliere-কে মলিয়ের বানানেই চিনিয়েছিলেন বাঙালিকে।

'অ' এবং 'আ’র এবং (ɔ) এবং (o) ধ্বনির উচ্চারণও ফরাসি শব্দের উচ্চারণের ক্ষেত্রে বাঙালি লেখকদের কাছে একটা সমস্যার বিষয়। সুতরাং ফঁতেন না ফোঁতেন, রঁসার না রোঁসার, মঁতেন না মোঁতেন, মঁতেস্কিয়ো না মোঁতেস্কিয়ো, মলিয়ের না মোলিয়ের, ফ্লবের না ফ্লোবের, রঁম্যা রলাঁ না রোঁম্যা রোঁলা, আরাগঁ না আরাগোঁ, তা বিবেচ্য। আমরা লক্ষ্য করি যে, La Fontaine-কে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন লা ফঁতেন। ফাদার দ্যতিয়েন লিখেছেন লা ফোঁতেন। Ronsard-কে ফাদার দ্যতিয়েন লিখেছেন রোঁসার। নন্দদুলাল দে এবং মিতা চাকলাদার লিখেছেন রঁসার। লোকনাথ ভট্টাচার্যের বাংলা অক্ষরে Montaine হয়েছেন মঁতেন। Montesquieu-কে পুষ্কর দাশগুপ্ত লিখেছেন মোঁতেস্কিয়্যো। Romain Rolland-এর বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে ফাদার দ্যতিয়েন রোম্যাঁ রোলাঁ লেখেন। অবন্তীকুমার সান্যাল, চিন্ময় গুহ প্রমুখেরা লেখেন রম্যাঁ রলাঁ। অরুণ মিত্রের কলমে Louis Aragon হয়েছেন লুই আরাগঁ। পুষ্কর দাশগুপ্ত তাঁকে করেছেন লুই আরাগোঁ। Flaubert-কে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এবং পুষ্কর দাশগুপ্ত ফ্লোবের লিখেছেন। নামী ফরাসি অভিধানগুলিতে উক্ত শব্দগুলির উচ্চারণ দেওয়া আছে এরকম - Montesquieu (mɔ̃tɛskjø), Montaine (mɔ̃taɲ), Fontaine (fɔ̃tɛn), Ronsard (rɔ̃sar), Moliere (mɔljer), Romain Rolland (rɔmɛ̃rɔlɛ̃), Flaubert (flobɛr), Louis Aragon (lwi araɡɔ̃)। ফরাসি ভাষায় (o) ধ্বনিটিকে রুদ্ধ স্বরধ্বনি এবং (ɔ) ধ্বনিটিকে মুক্ত স্বরধ্বনি ধরা হয়। সুতরাং আলোচ্য নামগুলিতে (flobɛr) ছাড়া কোথাও প্রথম অক্ষরে রুদ্ধ উচ্চারণ বা বানানের প্রয়োজন নেই। বাংলায় যেমন মন, বন প্রভৃতি শব্দে ওকার দেওয়া হয়না, কিন্তু উচ্চারণে সেগুলি যেমন মোন, বা বোন-এর মতো নয়, তেমনই জন বা শন-এর মতোও নয়। ফরাসি এই শব্দগুলোও তেমনই। অবশ্য, পুষ্কর দাশগুপ্ত (ɔ) ধ্বনিটিকে ও-কার দিয়ে লিখতেই অভ্যস্ত। Romain Rolland নামটিকে রম্যাঁ বা রোম্যাঁ লিখলে আর একটি সমস্যাও দেখা দেয়। বাংলা শব্দের মধ্যস্থলে বা শেষে য-ফলা ব্যবহারের সেই সমস্যা যা বোদলেয়ার শব্দটির ব্যাখ্যার সময় আলোচনা করা হয়েছে। ফলে রম্যাঁ বা রোম্যাঁ-কে রম্মাঁ বা রোম্মাঁ উচ্চারণ করা হতেও পারে। বিশেষত আমরা যখন ‘রম্যানি বীক্ষ্য মধুরাংশ্চ’-এর কবির দেশের লোক।

এবার আমাদের সকলের অতি প্রিয় Victor Hugo’র নামের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ নিয়ে আলোচনা করা যাক। ভিক্তর উগোর নাম শিক্ষিত বাঙালির কাছে ভিক্টর হুগো নামেই পরিচিত। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মনস্বী শিবনারায়ণ রায় মূল ফরাসি থেকে যখন জাঁ পল সার্ত্রের 'Les Mains sales' নাটকটিকে ‘নোংরা হাত’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন, তখন তিনি ঐ নাটকের বাকি চরিত্র-নামের ক্ষেত্রে ফরাসি ধ্বনি বজায় রাখলেও ‘হুগো’ নামের চরিত্রটির ক্ষেত্রে ইংরেজি উচ্চারণটিকেই অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। কিন্তু তারও ছত্রিশ বছর আগে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস Hugo (ygo)-কে বাংলা উচ্চারণে লিখেছিলেন - য়ুগো এবং ইংরেজি উচ্চারণে হিউগো। পরে লোকনাথ ভট্টাচার্য এবং নারায়ণ মুখোপাধ্যায় Victor Hugo (viktɔr ygo)-কে ভিক্তর উগো লিখেছেন। লোকনাথ উ-এ একটি য-ফলা দিলেন। পরে চিন্ময় গুহ ভিক্তরের সংযুক্ত ব্যঞ্জন ভেঙে ক-য়ে হসন্ত দিয়ে ত লিখলেন এবং য়’তে-য-ফলা এবং উকার দিয়ে লিখলেন ‘য়্যুগো’। Hu দিয়ে ফরাসি শব্দ শুরু হলে (y) ধ্বনিটি হয় এবং এই ধ্বনিটি (u) ধ্বনির থেকে আলাদা যদিও একই স্বনিমের অংশ। ("On considere generelment que (y) et (ɥ) d’un part et, (u) et (w) du’autre part sont de variants phonetics d’une seul phoneme." - Le Bon Usage) তাই (y) ধ্বনিটির উচ্চারণ বোঝাতে বাংলায় য-ফলা দেবার রীতিও আছে। কিন্তু, বাংলায় স্পষ্টতই ‘উ’ অক্ষরটি থাকতে খামোকা ‘য়’ আর একটা ‘উ’-কার লাগাতে যাব কেন? ফরাসি শব্দের বাংলা রূপে য-ফলার আধিক্য যদি কমাতেই হয়, তবে উগোর নাম থেকেই তা শুরু হোক। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, পুষ্কর দাশগুপ্তেরা উগোর নামে য-ফলার ব্যবহার করেননি।


আকরগ্রন্থঃ

● হঠাৎ নবাব, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কলকাতা, ১৮০৬ শকাব্দ
● বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, কলকাতা, ১৯১৭
● ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রূপা, কলকাতা, ১৯৮৯
● ভাষার ইতিবৃত্ত, সুকুমার সেন, কলকাতা, বর্ধমান, ১৯৪২
● Le Bon Usage, Maurice Grevisse and André Goosse, Bruxelles, 2008
● রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও রম্যাঁ রলাঁ, অবন্তীকুমার সান্যাল, শ্রী রমণাশ্রম, তামিলনাড়ু, ১৯৬২
● পাঁচশো বছরের ফরাসী কবিতা, অরুণ মিত্র, প্রমা, ২০০৬
● গদ্য সংগ্রহ, ফাদার দ্যতিয়েন, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা ২০১২
● কথা, ঝা্‌ক প্রেভের, পলাশবরন পাল, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ১৪১৬
● তার্ত্যুফ, মলিয়ের, অনুবাদ - লোকনাথ ভট্টাচার্য, সাহিত্য অকাদেমি, ২০০৭
● লোকনাথ ভট্টাচার্য রচনাবলী, সম্পাদনা, বীতশোক ভট্টাচার্য, এবং মুশায়েরা, কলকাতা, ২০০৫
● আমাদের কথা, পুষ্কর দাশগুপ্ত, এবং মুশায়েরা, কলকাতা, ২০০৫
● https://bahuswar.wordpress.com.Pushkar Dasgupta
● শব্দ, লোকনাথ ভট্টাচার্য, সাহিত্য অকাদেমি, দিল্লি, ২০০৫
● শার্ল বোদলেয়ারের গদ্য, নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, প্রতিভাস, কলকাতা, ২০০৭
● সার্ত্র্‌ ও তাঁর শেষ সংলাপ, অরুণ মিত্র, প্রমা, ২০০৫
● রম্যাঁ রলাঁ, চিন্ময় গুহ, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০০২
● ভিক্‌তর য়্যুগো, চিন্ময় গুহ, প্যাপিরাস, কলকাতা ২০০৩