আরেক রকম ● দশম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২২ ● ১-১৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বাংলা ভাষার অন্তর্জলি যাত্রাকালে

সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়


ধরা যাক, বাড়ির ছোটো বাচ্চাকে সবাই মিলে খুব বকা-ঝকা করছেন। কানটান মুলেও দিতে পারেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুটির অপরাধ কী? সে নাকি, যখন-তখন যেখানে-সেখানে মাতৃভাষায় মানে বাংলায় কথা বলে ফেলছে। অভিভাবকেরা অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাকে সবসময়, সর্বত্র ইংরাজি বা নিদেন-পক্ষে হিন্দিতে কথা বলার অভ্যেস করাতে পারছেন না। বাচ্চা মাঝে-মাঝেই যত্র-তত্র বাংলায় কথা বলে ফেলে।

এই পর্যন্ত পাঠের পরে অনেকেই আছেন যাঁরা আলোচিত ঘটনাটা গল্প-কথা এবং চরিত্রগুলো কাল্পনিক ভাবছেন তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, পশ্চিমবঙ্গে সর্ব-ভারতীয় বোর্ডের এমন স্কুল আছে, যেখানে বাচ্চাদের বাংলায় কথা বলতে দেওয়া হয় না। না, কোনো নিয়ম বা আইন করে দেওয়া নেই, কিন্তু এটাই দস্তুর। অভিভাবকদের একটা অংশ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছেলে-মেয়েদের স্মার্ট করতে সানন্দে মেনে নেন এই ফতোয়া। যাঁরা মন থেকে মানতে পারেন না তাঁরাও স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদে যেতে চাইছেন না, রোষানলে পরার ভয়ে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে গর্বিত হওয়ার বদলে বাঙালির এই হীনমন্যতা কেন? কারণটা সম্ভবত যে বাঙালি, বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে বুঝেছে যে হিন্দি-ইংরাজি না শিখলে দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বাঁচতে হয়, সে কেন ঝুঁকি নেবে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এছাড়াও আরও এক শ্রেণীর শিকড়-বিচ্ছিন্ন, উচ্চকোটির বাঙালি আছেন যাঁরা বাংলাটাকে নিজের ভাষা বলেই মনে করেন না। হয়তো এই কারণেই কয়েক বছর আগে, ব্যক্তিগত কাজে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেখেছিলাম বড়ো বড়ো হোর্ডিং-এ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বিজ্ঞাপন। সেটাও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, শহর থেকে মফস্বল ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন ইংরেজি মাধ্যমের বাড়-বাড়ন্ত।

শিক্ষিত বাঙালির বিরাট অংশ বরাবরই ছিল দ্বিভাষিক। সরকারি বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখেই ইংরেজি-বাংলা দুই ভাষাতেই দক্ষ। অথচ বর্তমানের এই নব্য ব্যবস্থায়, যেখানে ত্রি-ভাষা নীতি কার্যকর হয়েছে, হিন্দির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সেখানে ইংরেজিতে কিছুটা দক্ষতা অর্জন করলেও ছেলেমেয়েরা বাংলা লিখতে-পড়তে পারছে না, শিখছে না আর অনেক অভিভাবক তাতেও আহ্লাদিত, গর্বিত। সুতরাং, যে জাতির শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মর মাতৃভাষার জ্ঞান ও পাঠ শূন্য প্রায় সেই ভাষার অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়ে গেছে, এই কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।

মাতৃভাষা বিমুখ হওয়ার জন্য বাঙালিকে শুধু দোষ না দিয়ে বাঙালির অসহায়তার দিকটাও বোঝার দরকার। মাতৃভাষা যদি ভবিষ্যতের কাজের ভাষা না হয়, অন্ন-বস্ত্র সংস্থানের ভাষা না হয় তাহলে মাতৃভাষা দুয়োরাণীই থেকে যাবে। উচ্চশিক্ষিত হয়ে বিদেশে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া কৃতি ছাত্ররাই শুধু নয়, বিশাল সংখ্যায় শ্রমজীবী বাঙালি এখন পরিযায়ী, ভিন্ন রাজ্যে বা বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছে জীবন-জীবিকার তাগিদে। বহুভাষিক ভারতে রাষ্ট্রীয় দাক্ষিণ্যে, পুষ্টিশালী হয়ে হিন্দি হয়ে উঠছে বিভিন্ন প্রান্তে সংযোগের ভাষা। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তাই সাধারণ বাঙালির আশ্রয় করছে হিন্দিকে এবং উচ্চ-শিক্ষিত বাঙালি আপন করে নিচ্ছে বা নিতে বাধ্য হচ্ছে ইংরেজিকে।

আবার বাংলায় ক্রমাগত হিন্দি ভাষার আধিপত্যবাদের আক্রমণ ও আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ, উদার বাঙালি। এখন এই সামগ্রিক হতাশার পরিমণ্ডলে বাংলাকে বাঁচাবার কি কোনো উপায় নেই বা সমস্যাগুলো কীভাবে চিহ্নিত করা যায়?

ইংরাজি ক্যালেন্ডারের মে মাস বাংলা ভাষার ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এক, রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মাস ও দুই ভারতবর্ষে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে, বাঙালির আত্ম-বলিদানের মাস। এই দুই ঘটনাকে স্মরণে রেখে শুরু করা গেল বাংলা ভাষার অন্তর্জলি যাত্রার ধারবাহিক কারণ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা এবং উত্তরণের পথ অনুসন্ধান। এই পর্বটিকে তাই প্রস্তাবনা পর্ব বলা যেতে পারে যার শেষ করা যেতে পারে কতগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করে, যেমন, বাংলাকে মুখের ভাষার সঙ্গে-সঙ্গে কাজের ভাষা কীভাবে করা যায়?

নিজভূমে বা পশ্চিমবাংলায় মাতৃভাষার অধিকারকে কীভাবে সুরক্ষিত করা যায়?

শিক্ষা, চাকুরি, বিভিন্ন পরিষেবা ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন কীভাবে সম্ভব?

মাতৃভাষার অধিকারের জন্য লড়াই আর সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার মধ্যে ফারাক কোথায়?

বাংলা ভাষার উন্নতি-কল্পে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দূরদৃষ্টির অভাব আছে কি?