আরেক রকম ● দশম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২২ ● ১-১৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

আমরা কি পিছনপানে এগিয়ে চলেছি?

অশোক ভট্টাচার্য


দিনকয়েক আগে ডঃ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-এর সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলা বই 'অপর' পড়ছিলাম। বইটি তাঁর লেখা কিছু প্রবন্ধ ও বক্তৃতার সংকলন। ২০১৮ সালে উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্র 'Can the Subaltern Speak' বিষয়ে একটি বক্তৃতা ও সাথে কিছু প্রশ্ন-উত্তর বিষয়ক লেখাটি পড়ছিলাম। সেই বক্তৃতায় তিনি সাবঅলটার্ন বা নিম্নবর্গীয়রা যে স্বাধীনভাবে নিজেদের বক্তব্য বা নিজেদের কথা প্রকাশ করতে পারে না, সে বিষয়ে তাঁরই একটি পারিবারিক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। যদিও তাঁর আক্ষেপ, তাঁর গবেষণাপত্রে, ঘটনাটি যে তাঁর পরিবারেরই একজন নিকট আত্মীয়ার সাথে সম্পর্কিত, তা তিনি উল্লেখ করেননি। যদিও তাঁদের পরিবারটি অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু ও উচ্চশিক্ষিত। যাঁরা সাবঅলটার্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা দেখিয়েছেন সাবঅলটার্ন বা নিম্নবর্গীয়রা কোনো শ্রেণি নয়, কোনো নির্দিষ্ট কাস্ট বা জাতও নয়, তারা একটি সামাজিক গোষ্ঠী। তারা গরিব পরিবারের হতে পারে, হতে পারে ধনী পরিবারেরও। তাদের অনেক কথা অব্যক্তই থেকে যায়। তাদের জীবনের কথা, পরিবারের কথা, সামাজিক ও লড়াই সংগ্রামের কথা ইতিহাসে লেখা হয় না। ইতিহাসে থাকে এলিট বা মধ্যবিত্তদের কথা। কারণ বেশিরভাগ ইতিহাস যাঁরা লেখেন তাঁরা এলিট বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। তাঁরা তাঁদের কথাই ইতিহাসে লেখেন। যে কথাটির উল্লেখ করেছিলেন তিনি তাঁর 'Can the Subaltern Speak' গবেষণাপত্রে। এবার তাঁর বক্তৃতার আসল কথায় আসা যেতে পারে।

১৯২৬ সালে পরাধীন ভারতে গায়ত্রী চক্রবর্তীর দিদিমার এক বোন মাত্র ১৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন। পরিবারের বা প্রতিবেশীদের ধারণা ছিল অবৈধ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সে ওই অল্প বয়সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। বিষয়টি নিয়ে যাতে প্রকাশ্যে কোনো কথাবার্তা না হয়, তথাকথিত সমাজকে এড়াতেই তাদের পরিবার ঘটনাটি চেপে যায়। কিন্তু ঘটনার ৫০ বছর পর, আশির দশকে একদিন গায়ত্রী চক্রবর্তীর মা তাঁকে তাঁর টিলা দিদুর আত্মহত্যার প্রকৃত ঘটনাটি বলেন। তাঁর টিলা দিদু আত্মহত্যার আগে একটি চিঠি লিখে যান। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, তিনি ছিলেন বাংলার একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর একজন বিপ্লবী সদস্যা। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একজন ইংরেজকে হত্যা করার। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ব্যর্থ হয়। সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীটির নির্দেশ ছিল কোনো একজন বিপ্লবী যদি তাঁর লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়, তবে তাঁকে নিজেকেই মৃত্যুর পথ বেছে নিতে হবে। টিলা দিদু ছিলেন এরকমই একজন বিপ্লবী, যিনি লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়েছিলেন। যদিও তিনি স্বেছায় মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন ঘটনার চার দিন পর। তিনি যে অবৈধ প্রেমে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে আত্মহত্যা করেননি তা প্রমাণ করতেই তাঁর পিরিয়ড হবার জন্য চার দিন পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। পিরিয়ড শেষ হবার পরই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। এসব কথা তিনি চিঠিতে লিখে গিয়েছিলেন।

যদিও চিঠিটি প্রকাশিত হয় ঘটনার ৫০ বছর পরে। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলেছেন, তিনি যখন তাঁর টিলা দিদুকে নিয়ে কিছু লিখতে চাইছিলেন, তখন তাঁর এক জ্যাঠতুতো দিদি, যিনিও একজন বিদুষী, তাঁকে টিলা দিদুর মতো অবৈধ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করা একজনকে নিয়ে কিছু না লেখাই উচিত - বলে নিষেধ করেন। অর্থাৎ তাঁর দিদি যত উচ্চশিক্ষিতাই হোন না কেন, তাঁরও বিশ্বাস তাই। প্রকৃত ঘটনাটি জানার, তাঁর দিদির কিন্তু বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তিনিও চান তথাকথিত সমাজের দিকে তাকিয়ে ঘটনাটি নিয়ে আর নতুন করে নাড়াচাড়া না করে বরং চেপে যাওয়াই ভালো।

আমার এই লেখাটির প্রসঙ্গ কিন্তু এসব নয়। প্রসঙ্গ হাঁসখালির ১৫ বছরের কিশোরীটির ওপর গণধর্ষণ, ঘটনার সাথে যুক্ত শাসকদলের প্রভাবশালী নেতৃত্ব, পুলিশের অসহযোগিতা ইত্যাদি। সবথেকে বড় বিষয় হলো মেয়েটির পরিবারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুলিসকে অবহিত না করতে পারা বা শাসকদলের চাপে, পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগটি ওই সময়ে গ্রহণ না করা, সর্বোপরি রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ঘটনাটিকে তাচ্ছিল্য করে 'ছোটো ঘটনা' বলে অভিহিত করা। এসব বিষয় নিয়ে রাজ্যের সমস্ত স্তরেই শুরু হয়েছে কিছু প্রতিবাদও। আর একটি বিষয়ও উল্লেখ করার মতো, তা হলো কিশোরীটি যখন যন্ত্রণায় কাতর, তখনও তাকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাবার তাগিদ উপলব্ধি করেনি। এমনকি কিশোরীটির মৃত্যুর পরমুহূর্তেই গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর মিলে শ্মশানঘাটে নিয়ে গিয়ে রাতের অন্ধকারে দেহটি দাহ করা হয়, যার নেপথ্যে ছিলনা কোনো চিকিৎসকের মৃত্যুজনিত শংসাপত্র। এসবও এখন আলোচনার অন্যতম বিষয়। সেই গ্রামের শাসকদলের মাতব্বররা কিন্তু আজও সেখানে দাপটে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে, একই জিনিস চলছে অন্য অনেক গ্রামেও। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছরের ঘটনাবলীর কথা নাই বা উল্লেখ করলাম। কিন্তু গত কয়েকদিনের ঘটনাবলী যদি দেখা যায়, তবে বোঝা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে এক ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যে নারীদের কোনো নিরাপত্তা নেই। পুলিশের করণীয় কাজ শাসকদলের হস্তক্ষেপ বা নির্দেশ ব্যতিরেকে হয় না। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ারও সকলের অধিকার নেই। রাজ্য সরকার বিশ্বাস করুক বা না করুক পশ্চিমবঙ্গে একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর আমলেই সারা দেশের মধ্যে সবচাইতে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। যতই 'কন্যাশ্রী'র কথা বলা হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ৪৮ শতাংশ বিয়ে হয় নাবালিকা বয়সে। 'কন্যাশ্রী' বা 'রূপশ্রী' নাবালিকা বিয়ে কতটা হ্রাস করতে পেরেছে না বৃদ্ধি পেয়েছে, এসব নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে। সর্বোপরি বলা যেতে পারে, এ রাজ্যে আইনের শাসন ভেঙ্গে পড়েছে। আরও কয়েকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। এত অন্যায়, এত অবক্ষয় চলছে, একটি মূল্যবোধহীন রাজনীতি চলছে, তবু সার্বিক প্রতিবাদ কোথায়? মানুষ বুঝতে পারছে এতসব অন্যায় চলছে, কিন্তু প্রতিবাদ করতে অনেকে এখনও ভয় পাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ তিনি সঠিক কথাই বলেছেন। এ রাজ্যে সবাই তৃণমূল। ধর্ষিতা ও ধর্ষক, চোর, ডাকাত, দুর্নীতিগ্রস্ত সবাই যে তৃণমূল কংগ্রেস, মুখ্যমন্ত্রী তা স্বীকার করে নিয়েছেন। এরপর তিনি বলবেন একটির পর একটি নির্বাচনে তাদের পক্ষে ফলাফলই নাকি তা বলে দিয়েছে, মানুষ কী চায়। এ রাজ্যের সব মানুষের সমর্থন রয়েছে তাদেরই পক্ষে! খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, আগুনে পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি যত ঘটনাই ঘটুক না কেন, আসল কথা হলো তার দলের ভোট পাওয়া।

এটা ঠিক, এরকম এক পরিস্থিতিতে যে কোনো দেশের, বিশেষ করে যে সমস্ত দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে, সেখানে বুদ্ধি জগতের মানুষদের বা সংবাদমাধ্যমের একটি বড় ভূমিকা থাকে। সত্যিই কি পশ্চিমবঙ্গে তা পালিত হচ্ছে? এসব নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন থাকছে।

এবার যদি সামাজিক দিক দিয়ে আসা যায়, তবে আমরা দেখবো বাংলার সমাজ সংস্কার বা সমাজ সচেতনতামূলক ভূমিকার একটি দীর্ঘ পরম্পরা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি বাংলা চলছে সেই পরম্পরাকে অনুসরণ করে? তথাকথিত সমাজ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?

ডঃ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর 'সাবঅলটার্নরা কি তাদের কথা বলতে পারে?' শীর্ষক গবেষণাপত্রে টিলা দিদুর যে কথাটির উল্লেখ করেছিলেন, সেই ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে। তাঁর আত্মহত্যার ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা গিয়েছিল ঘটনার ৫০ বছর পর। হাঁসখালির কিশোরীটি আত্মহত্যা করেনি, সে বাঁচতে চেয়েছিল। সে কয়েকজন মানুষ নামক পশুদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিল। সে চিকিৎসা চেয়েছিল, চেয়েছিল বাঁচতে। যদি তার মৃত্যুকালীন জবানবন্দী নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো অনেক প্রকৃত ঘটনা জানা যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে তার কোনো সম্ভাবনা বা সুযোগ দেওয়া হয়নি বা নিতে দেওয়া হয়নি। ১০০ বছর আগের আত্মহত্যার ঘটনাটি ছিল সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কার্যকলাপের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু পরিবারের লোকেদের ধারণা ছিল অবৈধ প্রেম ও অন্তঃসত্ত্বাজনিত। তথাকথিত সমাজের হয়তো বা এরকম ধারণাই হয়েছিল। ১০০ বছর পরেও কি সমাজের খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে? শুধু তথাকথিত সমাজকে ভয় করেই নয়, এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে শাসকের ভয়। শুধু অর্থের বিনিময়ে বা প্রলোভনে কত মানুষ কত অন্যায় বুঝেও তা চেপে যাচ্ছে। আবার অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে শাসকশ্রেণি কতশত অন্যায় চাপিয়ে দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে এসব নিয়েও। আমার প্রশ্ন কিশোরীটির বাবাও কি তথাকথিত সমাজের ভয়ে তার কন্যার ধর্ষণের ঘটনাটি জানাতে ভীত হয়েছিলেন?

১০০ বছর আগে টিলা দিদু আত্মহত্যা করেছিল অবৈধ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নয়, অন্তঃসত্ত্বা হয়েও নয় - একজন ইংরেজকে হত্যা করতে লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সে আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু তথাকথিত সমাজ তাকে অন্তঃসত্ত্বা ও অবৈধ প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার ঘটনার সাথে অভিযুক্ত করেছিল। যদিও সত্যতা জানতে ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। হাঁসখালির কিশোরীটির মৃত্যুর কারণ হিসাবে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী 'প্রেমঘটিত ও অন্তঃসত্ত্বা' বলে মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ বলবেন মেয়েটি 'মন্দ মেয়ে' ছিল। তথাকথিত সমাজের ভয়ে তার সাথে শাসকদলের নেতাদের হুমকি ও আতঙ্কের কারণে কিশোরীটির সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। আবার সেই মৃত্যুর কোনো শংসাপত্র না থাকা সত্ত্বেও রাত পোহাবার আগেই শাসকদলের মাতব্বরদের নজরদারিতে কিশোরীটির দেহ দাহ করা হয়। জানিনা এর পরেও আমরা কি বলবো, সমাজ এগোচ্ছে না পিছোচ্ছে? জানিনা প্রকৃত ঘটনা জানতে আবার আমাদের আরও ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হবে কিনা? টিলা দিদুরা যতই উচ্চবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারের হোক না কেন, আবার হাঁসখালির ১৫ বছরের কিশোরীটি যতই নিম্নবিত্ত ও স্বল্পশিক্ষিত পরিবারের হোক না কেন, উভয়কেই 'সাবঅলটার্ন' বলা যেতে পারে। এরা কেউ তথাকথিত সমাজের ভয়ে নিজেদের কথা বলতে পারে না।